ভারতের মানচিত্রে উত্তরপ্রদেশের চেহারাটা দেখলেই মনে হয় , যেন হিমালয়ের পাদদেশে হিমালয় -দুহিতা উমা বা দুর্গার বাহন এক মহাসিংহ। তার শিরোভাগে অবস্থিত জেলাগুলির মধ্যে আলমোড়া যেন চক্ষুস্থান। এক চক্ষুস্মান পুরুষের পাদস্পর্শে পবিত্রীকৃত হয়েছিল আলমোড়া তিনবার। সে পুরুষ পুরুষসিংহ স্বামী বিবেকানন্দ। আমরা সে কথায় পরে আসছি।
দিল্লি থেকে আলমোড়া (৩৭৮ কি.মি.) বাসে যাওয়া যায়। সময় লাগে প্রায় ১২ ঘন্টা। সাধারণত লোকে লক্ষ্ণৌ হয়ে যায়। লক্ষ্ণৌ থেকে কাঠগোদাম (৩৮৮ কি.মি. ) রাত ভোর রেল যাত্রা। সকালে কাঠগোদাম থেকে বাস , ট্যাক্সি ইত্যাদিতে আলমোড়া (৮৭ কি.মি. খৈরনা হয়ে ) যেতে লাগে প্রায় ৩ ঘন্টা। সমুদ্রতল থেকে আলমোড়ার উচ্চতা ৪৯৩৮ ফুট।
আলমোড়ার কাছাকাছি কয়েকটি জায়গা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে প্রসিদ্ধ। রানীক্ষেত (৫০ কি.মি.) তুষারাবৃত হিমালয়ের দৃশ্য, মিষ্টি বাতাস আর অপূর্ব আবহাওয়ার জন্যে যাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয়। রানীক্ষেত সমুদ্রতল থেকে ৬০০০ ফুট উচ্চ।
কৌশানির ( ৫৩ কি.মি., সমুদ্রতল থেকে ৫৬৭০ ফুট ) প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনন্য। ১৯২৯ সালে মহাত্মা গান্ধী এখানে এসে কিছুদিন ছিলেন। এখানের পরিবেশে তিনি গীতা -অনাসক্তি -যোগ- ভাষ্য রচনা করেন। তিনি বলেছিলেন , প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এ স্থানের চেয়ে সেরা আর কোন জায়গা আছে কিনা সন্দেহ। এখানের সূর্যোদয় , সূর্যাস্ত দেখার মত। সূর্যোদয় কালে হিমালয়ের তুষারশুভ্র শৃঙ্গগুলি হয়ে ওঠে টকটক লাল, আর সূযাস্তের সময় সোনার রঙ।
একটি অপূর্ব হ্রদকে বেষ্টন করে ছোট পাহাড়ি শহর নৈনিতাল (আলমোড়া থেকে ৬৮ কি.মি. সমুদ্রতল থেকে ৬৮১৪ ফুট ) সকলেরই জানা। হুদের তীরে আর পাহাড়ের উপরের বনরাজির সৌন্দর্য অপূর্ব। হৃদে নৌকাবিহার এখানের এক বিশেষ আকর্ষণ ; যেমন আকাশ পথে তারের দোলায় চূড়ায় উঠে হিমালয় আর হ্রদাদি দর্শন। রাত্রে হরেক ঘরবাড়ি আর রাস্তার আলোর মালা হৃদের লহর কাটা জলে যখন দুলে ওঠে তখন যেন এক ঐন্দ্রজালিক মায়ার সৃষ্টি হয়। এখান থেকে ২৫ কি.মি. -এর মধ্যে মৈনা শৃঙ্গ , ভীমতাল, সাততাল প্রভৃতি দেখতে গিয়ে থাকেন।
আলমোড়া থেকে ১২২ কি.মি. দূরে পিথোরাগড় শহর প্রাচীন মন্দির ইত্যাদির জন্যে প্রসিদ্ধ। কুমায়ুন অঞ্চলের প্রাচীন চাঁদ রাজাদের সময়কার বহু দর্শনীয় স্থানের অবশেষে এখানে রয়েছে। এটি যেন একটি ছোটখাট কাশ্মীর। সমুদ্রতল থেকে এর উচ্চতা ৫৪৪৫ ফুট। পিথোরাগড় থেকে ২০৮ কি.মি. দূরে উত্তর প্রদেশের হিমালয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হিমবাহ মিলাম। শেষের ৫৪ কি.মি. হেঁটে যেতে হয়।
আলমোড়া এককালে নাকি ভগবান বিষ্ণুর আবাসস্থল ছিল। স্কন্দ পুরাণে এমন উল্লেখ আছে। কশায়া পাহাড়ের উপর ৫ কি.মি. লম্বা ঘোড়ার জিনের আকারের সরু লম্বা চূড়ায় শহরটি অবস্থিত। প্রায় ১২ কি.মি. এলাকায় এ শহরের জনবসতি (১৯৮১ -র আদমশুমারি অনুসারে ) ২০, ০০০ এর কিছু বেশি। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৪.৪ থেকে ২৯.৪ সেলসিয়াস কমে বাড়ে। বৃষ্টিপাত নৈনিতাল , শিমলা, মুসৌরি বা দার্জিলিং -এর তুলনায় কম, গড় ৩৭"। বলা যায় নাতিশীতোষ্ণ , নাতি-আদ্র। খুব স্বাস্থ্যকর জায়গা বলে আলমোড়া বহুকাল প্রসিদ্ধ। এখান থেকে উত্তরে নন্দাদেবী , ত্রিশূল প্রভৃতি প্রায় কুড়িটি হিমালয়ের তুষার ঢাকা শৃঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়। ১৫৯২ খিরষ্টাব্দে চাঁদ রাজাদের রাজধানী হিসাবে এ শহরের পত্তন। এখানের দীর্ঘ বাজার এলাকা পুরানো কালের পাহাড় অঞ্চলের বাজার হিসাবে নাম করা।
শহর থেকে ৫ কি.মি. দূরে কালিমঠ। সেখান থেকে সমস্ত শহরটি সুন্দর দেখায়। আর কিছু দূর গেলেই এক পাহাড়ের উপর কাশার দেবীর ও শিবের মন্দির। ৮ কি.মি. দূরে এ অঞ্চলের বিখ্যাত গল্লু দেবতার মন্দির। জায়গাটার নাম চৈতাই। ইনি এক রাজপুত্র ছিলেন। কিন্তু অলৌকিক শক্তির জন্যে দেবতায় রূপান্তরিত হয়েছেন। সকলের সব অভীষ্ট সিদ্ধ করেন। ভক্তরা মন্দিরে ঘন্টা দান করেন। ফলে এত ঘন্টা যে মন্দির ও সমস্ত চওরের ঘন্টা গুনে শেষ করা শক্ত।
৩৪ কি.মি. দূরে জগেশ্বর শিবের মন্দির অপূর্ব পরিবেশে বিশাল দেওদার বন আর জটাগঙ্গা নদীর তীরে। এখানে আর এক শিব আছেন। তাঁর নাম মহামৃত্যুঞ্জয়। তাঁকে বলে বুড়ো শিব , আর জগেশ্বর হলেন বালক শিব। তবে স্থানীয় লোক বলে ইনি দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম।
উত্তর-পূর্বে প্রায় ৮০ কি.মি. বাসে কাপকোট গিয়ে ৫৮ কি.মি. হাঁটা পথে পিন্ডারী হিমবাহ। এই হিমবাহেই এ অঞ্চলে সবচেয়ে সহজে যাওয়া যায়।
শহরের ৩ কি.মি. দূরে এক হরিণক্ষেত্র আছে। ৩০ কি.মি. দূরে বিন্সারের অরণ্য সৌন্দর্যে সকলেরই মনোহরণ করে।
প্রকৃতি ও পর্বতপ্রিয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বার দুই (১৯০৩, ১৯৩১) আলমোড়ায় এসে থেকেছেন এবং তাঁর 'শিশু', 'ছড়ার ছবি ', 'সেঁজুতি '-র অনেকগুলি নিয়ে চল্লিশটির বেশি কবিতা আলমোড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশে বসে লেখা।
স্বাস্থ্যের আকর্ষণ ছাড়া আলমোড়া কর্ণপ্রয়াগ , রুদ্রপ্রয়াগ , কেদারনাথ , বদ্রীনাথ , গঙ্গোত্রী , যমুনোত্রী , কৈলাশ প্রভৃতি তীর্থে যাবার অন্যতম পথও। শ্রীরামকৃষ্ণের সন্তানদের মধ্যে স্বামী অখণ্ডানন্দ (গঙ্গাধর ) হিমালয় অঞ্চলে ও তিব্বতে অনেক ঘুরেছিলেন। এঁদের মধ্যে তিনিই আলমোড়া প্রথম যান। শ্রীরামকৃষ্ণের দেহান্তের পর নরেন্দ্রাদি (বিবেকানন্দ প্রমুখ ত্যাগী যুবকগণ) বরাহনগর মঠে থাকছিলেন। কিন্তু ত্যাগ ও তপস্যার (সেবার) প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাঁদের ছিটকে বার করে নিয়ে গেসল ভারতের নানা ক্ষেত্রে।
বিবেকানন্দ কয়েকবার এখান ওখান ঘুরে এসে হিমালয়ে এক সাধনার নির্জন স্থান খোঁজ করার উদ্দেশ্যে অখণ্ডানন্দকে সঙ্গী করে কাঠগোদাম হাজির হলেন। একশ বছের আগে বাস বা রাস্তা কিছুই ছিল না। দন্ড-কমণ্ডলু আর ভিক্ষান্ন সম্বল করে বিবেকানন্দ ও খণ্ডানন্দ পাহাড়ি পথে হেঁটে নৈনিতাল পৌঁছলেন।
কদিন পর আবার চলা শুরু হল আলমোড়া পথে। বিবেকানন্দ মাঝে মাঝে নির্দিষ্ট পথ ছেড়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলতে লাগলেন। তৃতীয় দিনে উভয়ে রাত কাটাবার জন্যে একটি মনোরম স্থান দেখতে পেলেন। পথের পাশে দিয়ে বয়ে গেছে কোশি (কৌশিকী) নদী। অসংখ্য ছোট-বড় নুড়ি আর পাথরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী পায়ে হেঁটে পেরিয়ে যাওয়া যায়। অপর দিক থেকে সরোতা নদী এসে পড়েছে কোশির বুকে। মাঝের ত্রিকোণাকৃতি ভূখণ্ড ক্রমশ উঁচু হয়ে গেছে। তার উপর একটি প্রকান্ড পিপুল গাছ। স্বামীজী বললেন , 'কি চমৎকার ধ্যানের জায়গা !' কোশিতে স্নান করে পেরিয়ে বসলেন সেই গাছের নীচে তৎক্ষণাৎ শরীর নিস্পন্দ হয়ে গেল গভীর ধ্যানে। বহুক্ষণ পর ধ্যান ভাঙলে অখন্ডানন্দকে (গঙ্গাধর ) বললেন , " আজ আমার এক গভীর জিজ্ঞাসার সমাধান হয়ে গেল। প্রথমে শব্দব্রহ্ম ছিল। অনুবিশ্ব আর বৃহৎ -বিশ্ব একই পরিকল্পনানুসারে সৃষ্ট। জীবাত্মা যেমন জীবদেহে , বিশ্বাত্মাও তেমন প্রকৃতিতে অবস্থিত। বাক আর অর্থের মতই এরা অচ্ছেদ্য। ব্রহ্মের এই দুই রূপ সনাতন। কাজেই আমরা যে জগৎ দেখি তা শাশ্বত নিরাকার ও শাশ্বত সাকারের সম্মিলন। "
এ জায়গাটার নাম কাঁকড়িঘাট , আলমোড়া থেকে ২৩ কি.মি. দূরে। শেষে যখন তাঁরা আলমোড়ার কাছাকাছি (৩ কি.মি.) পৌছেছেন তখন স্বামীজী পথশ্রমে ও প্রচণ্ড ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর। পা ফোস্কায় ভরে গেছে। প্রায় অজ্ঞান হয় স্বামীজী তখন একখণ্ড পাথরের উপর শুয়ে পড়লেন। অখণ্ডানন্দ দিশেহারা হয়ে কিছু খাবার আর জলের খোঁজ করতে ব্যস্ত হলেন। অনতিদূরেই এক কবরস্থানের পাশে এক কুটরীর কাছে এক মুসলমান ফকিরকে দেখতে পেয়ে তাঁর কাছে গেলেন। ফকিরের একটি শশা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ফকির নিজেই শশাটি নিয়ে ছুটে এলেন। কিন্তু বললেন , তিনি মুসলমান। স্বামীজী ক্ষীণকন্ঠে বললেন , ' তাতে কি ? আমরা সবাই কি ভাই নেই ? ' শশাটি খেয়ে স্বামীজীর প্রাণরক্ষা হল। ..... স্বামীজী আমেরিকা থেকে ফিরে দ্বিতীয়বার যখন আলমোড়া যান, আর তাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়, তখন সভাস্থলে ভিড়ের মধ্যে সেই ফকিরটিকে দেখে স্বামীজী ঠিক চিনতে পারেন এবং সভাস্থলে তাঁকে এনে তাঁর দ্বারা তাঁর জীবনরক্ষার কাহিনী কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সকলকে শোনান।
স্বামীজী প্রথম বার যখন আলমোড়া গিয়ে পৌঁছলেন সেটা ছিল ১৮৯০ সালের আগষ্ট মাসের শেষ বা সেপ্টেম্বরের প্রথম। শহরে পৌঁছেই স্বামী সারদানন্দ ও কৃপানন্দের (বৈকুন্ঠ নাথ সান্যাল ) সঙ্গে স্বামীজী ও অখণ্ডানন্দের দেখা হল। তাঁরা স্বামীজীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আলমোড়ায় অপেক্ষা করছিলেন। সকলেই শহরের এক অতি সজ্জন ব্যক্তি , ধনী হলেও ধনলাভের কালিমা যাঁকে স্পর্শ করেনি --লালা বদ্রি শা'র বাড়িতে উঠলেন।
১৮৮৯ সালে যখন স্বামীজী আলমোড়া যাবার কথা ভাবছিলেন , তখন বদ্রীনাথ থেকে অখণ্ডানন্দ বদ্রি শা'কে স্বামীজীর পরিচয় দিয়ে তাঁর আলমোড়ায় যাবার ইচ্ছার কথা জানান। স্বামী বিবেকানন্দের পরিচয় দিতে গিয়ে অখণ্ডানন্দ সে চিঠিতে লিখেছিলেন যে , বিবেকানন্দ শুধু উচ্চ শিক্ষিত নন , ঈশ্বরের জন্যে যথার্থই সর্বস্ব ত্যাগ করে তিনি কঠোর সন্ন্যাস-জীবন যাপন করেন এবং তিনি 'পরমহংস ' পর্যায়ের এক উচ্চকোটি সন্ন্যাসী।
শ্রী রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে থাকা কালেই বিবেকানন্দ (নরেন্দ্র ) সমাধি আস্বাদ করেছিলেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যাতে তিনি সেই ব্রহ্মাস্বাদেই ডুবে থাকতে পারেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ চেয়েছিলেন নরেন লোককল্যানের জন্যে উচ্চ ভূমিতেই না থেকে মানুষের মাঝে নেমে আসুক। যেন অলৌকিক ভাবেই তা ঘটেছিল আর সে বিষয়ে স্বামীজীর আলমোড়ায় অবস্থান স্মরণীয় হয় থাকবে।
লালা বদ্রীর শা'র আতিথেয়তায় কোন ত্রূটি ছিল না। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের মন ছটপট করছিল অন্য কিছুর জন্যে, নির্জনতার জন্যে , গভীরতর আধ্যাত্মিক উপলব্ধির জন্যে। তিনি একাকী বেরিয়ে পড়লেন। ......কাশার দেবী পাহাড়ের এক গুহায় চলল নিরবচ্ছিন্ন দিনরাত্রি কঠোর তপস্যা। একান্ত নির্জনতায় , নৈঃশব্দে ধীরে ধীরে তাঁর মুখমন্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠলো এক দিব্য আলোকে , চূড়ান্ত সত্যের প্রভায়। যেন বুঝলেন শ্রীরামকৃষ্ণের 'জ্ঞানের পরে বিজ্ঞান ' কথার অর্থ। শুধু ব্রহ্মজ্ঞানে ডুবে থাকা নয়। ....' তিনিই সব হয়েছেন'--- জেনে সর্বজীবের কল্যাণই শেষ কথা। নরেনের বিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের ইচ্ছা-বীজ অঙ্কুরিত হল বিবেকানন্দের অপরোক্ষ অনুভূতির প্রত্যয়ে।
আলমোড়ায় ফিরেই খেলেন সেই জগতের এক ধাক্কা। ভগিনীর উদ্বন্ধনে জীবনান্তের সকরুণ সংবাদ। চার সন্ন্যাসী মিলেরওনা হলেন বদ্রীনাথের পথে । কিন্তু প্রায় দু'শ কিলোমিটার হাঁটার পর একের পর একজন অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলেন। অগত্যা কিছু নেমে সাধু-সন্তদের প্রিয় হৃষিকেশে পৌঁছলেন , যেখানে 'হর হর' রবে হিমালয়ের উপর থেকে বয়ে গঙ্গা ভারতের সমতলে উপনীত হচ্ছে। কিছুদিন পর মীরাট থেকে আবার নিঃসঙ্গ একাকী পরিব্রাজক ভারত -পথিক , সে ভারতকে চিনতে যার সেবার জন্যেই তাঁর জন্মগ্রহণ। কত অঘটন ঘটে গেল ! নীলাম্বুরাশি পেরিয়ে আমেরিকার আকাশে ক্যালঝ্ঞ্ঝার মাঝে বজ্রের মত ফেটে পড়লেন। হেয় ম্লানমুখী ভারত আবার জগতের সামনে আপন প্রভায় সমুজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
বিশ্ববন্দিত বিবেকানন্দ ১৮৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতে ফিরলেন। সিংহল থেকে শুরু হল দেশজুড়ে অগণিত দেশবাসীর অকুন্ঠ অভিনন্দন আর প্রত্যুত্তরে ' ভারতে বিবেকানন্দ ' বিধৃত স্বামীজীর অনবদ্য বক্ত্রতামালায় ক্লিষ্ট খিন্ন নিদ্রিত ভারতবাসীর জন্যে হৃদয় ঢালা ভালবাসা দিয়ে ভরা অনন্য জাগানিয়া গান ! ক'বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যে দার্জিলিং -এ কিছুদিন কাটিয়ে পূর্ন স্বাস্থ্যোদ্ধার মানসে আবার আলমোড়া যেতে চাইলেন। ....ইতোমধ্যে কলকাতায় ১ লা মে ১৮৯৭ রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা হল। ৬ ই মে আলমোড়ার দিকে পা বাড়ালেন। আসল উদ্দেশ্য কিন্তু হিমালয় অঞ্চলে একটি আশ্রম স্থাপন ,' যেখানে কাজই প্রাধান্য পাবে না, প্রাধান্য পাবে শান্ত সমাহিত ভাব আর ধ্যানের গভীরতা। '
এবারে সবকিছুই অন্য রকম। স্বামীজীর বাণীর শ্রুতিলেখক গুডউইন এবং অন্যরা এসেছেন কাঠগোদামে আলমোড়া থেকে। স্বামীজী ঘোড়ার পিঠে পাহাড় চড়বেন, সঙ্গে থাকবেন গুডউইন। আলমোড়ার কাছাকাছি রাস্তায় বহু লোক অপেক্ষা করছিল। স্বামীজিকে একটি সুসজ্জিত ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে শোভাযাত্রা করে নিয়ে যেতে লাগল বাকী পথ। পথের পাশের বাড়ী থেকে গৃহবধূরা মাঙ্গলিক পুষ্পাক্ষত বৃষ্টি করতে লাগলেন। লালা বদ্রি শা'র বাড়ীর সামনে প্রকাণ্ড সামিয়ানা টাঙান হয়েছে। প্রায় তিন হাজার লোক সেখানে সমবেত। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দুধারের বাড়ীর আলোক-সজ্জায় চারদিক আলোকিত।
অভ্যর্থনা সমিতির পক্ষ থেকে পণ্ডিত জ্বালাদত্ত জোশি হিন্দিতে একটি সংক্ষিপ্ত অভিনন্দন পাঠ করলেন। তাতে তাঁর পাশ্চাত্ত্যে আধ্যাত্মিক বিজয়ের উল্লেখ করে বলা হল, 'আপনি কৃতার্থ , আপনার পরম শ্রদ্ধেয় গুরুদেব গৌরবান্বিত , আর ভারতভূমি ধন্য।' স্বামীজীর হিমালয়ে আশ্রমপ্রতিষ্ঠার ইচ্ছায় কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ' শঙ্করাচার্যও হিমালয়ে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আপনার কল্পিত আশ্রম কুমায়ুনীদের অশেষ কল্যাণ করবে। ' এর পর লালা বদ্রি শাহ খুলঘরিয়ার পক্ষ থেকে একটি ইংরেজি ভাষণ পাঠ করেন পণ্ডিত হরিরাম পাণ্ডে। অপর এক পণ্ডিত সংস্কৃতে একটি অভিনন্দন পাঠ করেন। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে দিন স্বামী বিবেকানন্দ ইংরেজিতে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণে অভিনন্দনের উত্তর দেন। তিনি বলেন , ' এই সেই পবিত্র ভূমি , সেখানে ভারতের প্রত্যেক যথার্থ সত্যপিপাসু ব্যক্তি জীবন-সন্ধ্যায় আসিয়া শেষ অধ্যায় সমাপ্ত করিতে অভিলাষী হয়। এই পবিত্রভূমির গিরিশখরে , গভীর গহবরে, দ্রুতগামিনী স্রোতস্বতীসমূহের তীব্র সেই অপূর্ব তত্ত্বগুলির কণামাত্র বৈদেশিকগনের নিকট হইতেও গভীর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়াছে এবং যেগুলিকে যোগ্যতম বিচারকগণ অতুলনীয় বলিয়া নিজেদের মত প্রকাশ করিয়াছেন। আমার প্রাণের বাসনা এই পর্বতরাজের ক্রোড়ে আমার শেষ দিনগুলি কাটাইবে। ' তিনি আরও বলেন , ' ভবিষ্যতে পৃথিবীর সর্বস্থানে হইতে বীরহৃদয় ব্যাক্তিগন এই শৈলরাজের দিকে আকৃষ্ট হইবেন - যখন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিরোধ ও মতপার্থক্য লোকের স্মৃতিপথ হইতে অন্তর্হিত হইবে , যখন তোমার ধর্মে ও আমার ধর্মে যে বিবাদ তাহা একেবারে অন্তর্হিত হইবে।'
এবারে তিনি আলমোড়ায় প্রায় তিন মাস কাটান। তার মধ্যে অবশ্য শরীর ভাল বোধ না হওয়ায় দুবারে প্রায় একমাস ৩২ কি.মি. দূরে দেউলধরে লালা বদ্রি শা'র এক বাগানবাড়িতে থেকে আসেন। সেখানে ফল দুষ খেয়ে আর প্রচুর ঘোড়ায় চড়ে তাঁর শরীর বেশ লাগতে লাগলো।
এসময় স্বামীজীর বেশ ক'জন গুরুভাই এবং অনুরক্তরা আলমোড়ায় এসেছিলেন। স্বামী শিবানন্দ (মহাপুরুষ মহারাজ) সাড়ে তিন কি.মি. দূরে পাতাল দেবীতে ধ্যান করে কাটাতেন। মাঝে মাঝে স্বামীজীর সঙ্গে দেখা হোত, স্বামীজী ওখান থেকেই তাঁকে সিংহল পাঠিয়ে দিলেন। সিংহলে রামকৃষ্ণ মিশনের কেন্দ্র স্থাপন করে কিছু দিন থেকে তিনি মঠ ফেরেন। ইতোমধ্যে আলমবাজার থেকে বেলুড়ে নীলাম্বর মুখুজ্জের বাড়িতে মঠ স্থানান্তরিত হয়েছে। মিশন স্থাপনের ক'দিনের মধ্যেই স্বামীজী কলকাতা থেকে চলে এসেছিলেন। কিছু ত্রাণের কাজও শুরু করে এসেছিলেন। কাজেই আলমোড়া থেকেই তাঁকে এ সব বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দিতে হচ্ছিল।
তা ছাড়া বহু জিজ্ঞাসু নানা প্রশ্ন নিয়ে হাজির হোত। দীর্ঘ আলোচনা চলতো। বিদেশী ভক্তরাও যতটা পারা যায় তাঁর সঙ্গ করতে চাইতেন। সব চিঠিতে নানা প্রশ্ন বা নির্দেশ প্রার্থনা থাকত। প্রচুর দীর্ঘ চিঠিও ক্রমাগত লিখতে হোত। শিষ্য শরৎ চক্রবর্তীকে লিখছেন , 'আমাদের দয়া নয় , প্রেম। সকলের মধ্যে আত্মদর্শন। ' স্বামী ব্রহ্মানন্দ (রাখাল ) -কে লিখছেন , ' আমাদের সঙ্ঘের উদ্দেশ্যের যে ছাপা বয়ান পাঠিয়েছিলে , তা সংশোধন করে পাঠালাম। ' এও চলছে আলমোড়া থেকে। আবার লিখছেন , 'প্রভুর পুজোর খরচ মাসে এক টাকায় চালাও। প্রভুর সন্তানেরা অনাহারে মরছে। ' 'কলকাতার সভার উদবৃত্ত দুর্ভিক্ষ -ত্রানে পাঠাও বা বস্তিবাসীদের সেবায় লাগাও। স্মৃতি- মন্দির বা ও সব এখন চুলোয় যাক। ' কাউকে লিখছেন , ' যারা নিঃসন্তান তাদের অনেকে যেমন বেরাল পোষে, আমার যেন সেই অবস্থা। আমার যেন পুরুষের চেয়ে নারীর ভাব বেশি। অন্যের যত দুঃখকষ্ট নিজের বুকে টেনে আনি। '
ইংরেজি ও বাংলা ছাড়া এর মধ্যে আবার কিছু চিঠি সংস্কৃতে লিখতেন। একটিতে লিখছেন , 'অহমধুনা আলমোড়া নগরস্যা কিঞ্চিৎ উত্তর কশ্চিদ বণিজ উপবনোপদেশে নিবসামি। ' এ চিঠিতে কিন্তু একটি মূল্যবান বস্তু ছিল। স্বামী শ্রদ্ধানন্দের প্রশ্নের উত্তরে স্বামীজী গীতার একটি শ্লোকের (২ য় অধ্যায় সংখ্যযোগের ৪৬ ) এক অপূর্ব ভাষ্য লেখেন।
আলমোড়া থেকেই স্বামী অখণ্ডানন্দের সেবার কাজে উৎসাহ দিয়ে লিখছেন , 'কার নাম -কিসের নাম ? কে নাম চায় ? দূর কর নাম। ক্ষুধিতের পেটে অন্ন পৌঁছাতে যদি নাম ধাম সব রসাতল যায় আহভাগ্যম মহাভাগ্যম। ' সারগাছিতে সেই কাজের সূত্রপাত। এদিকে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ (শশী মহারাজ ) কে মাদ্রাজে পাঠিয়েছেন এবং নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
আলমোড়া থেকে স্বামীজী চলে যাবেন জানতে পেরে স্থানীয় লোকেরা স্বামীজীর কিছু ভাষণ শোনবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠলো। স্থানীয় ইংরেজ বাসিন্দারা পাশ্চাত্যে স্বামীজীর বাগ্মিতার কথা শুনেছিলেন। তাঁরাও ইংলিশ ক্লাবে (বর্তমান অফিসার্স মেস ) একটি বক্ততার আয়োজন করলেন। ২৭ জুলাই স্বামীজী জেলা স্কুলে (বর্তমান রাজকীয় ইন্টার কলেজ) হিন্দিতে ভাষণ দিলেন। পূর্বে কখন হিন্দিতে বললেও একটি কঠিন বিষয়ের উপর আরগর্ভ ভাষণ স্বামীজীর এই আলমোড়াতেই প্রথম। স্বামীজী একখানি চিঠিতে নিজে তা উল্লেখ করেছিলেন। স্বামীজীর বক্ত্রিতা হিন্দি ভাষাকে নতুন মর্যাদা দিয়েছিল এবং শ্রোতাদের মধ্যে হিন্দিভাষী পণ্ডিতরা মন্তব্য করেছিলেন , এ ভাষণ শুনে তাঁদের মনে হয়েছে যে , হিন্দিতেও বাগ্মি তা সম্ভব।
সে সভায় বিষয় ছিল ' তত্বে ও প্রয়োগে বেদের শিক্ষা। ' প্রায় ৪০০ লোক মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল যখন স্বামীজী কঠিন বিষয়টি প্রকাশের প্রয়াসে হিন্দিতে স্বতঃ নতুন নতুন শব্দ সৃষ্টি করে বলে যাচ্ছিলেন। হিন্দিভাষীদের মধ্যে পণ্ডিতরা হিন্দিকে তেমন সুনজরে দেখতেন না। বাঙালি পণ্ডিত মধুসূদন সরস্বতী তুলসীদাসের 'রামচরিতমানসে'র প্রতি শ্রদ্ধা জাগান। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে বিগত শতাব্দীতে প্রথম হিন্দি গদ্য রচনা ও পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা হয়। এই পশ্চাদ পটে স্বামীজীর এ হিন্দি ভাষণের মূল্য আনেক।
২৮ এ জুলাই ইংলিশ ক্লাবের বক্তৃতা সম্বন্ধে শ্রীমতি হেনরিয়েটা মুলর লিখেছিলেন , ' সময় সময় মনে হচ্ছিল 'আমি' নেই , 'তুমি' নেই , 'এ ' নেই , 'ও ' নেই , বক্তা , তাঁর বাণী আর শ্রোতা সব সেই আত্মবস্তুতে লীন হয়ে গেছে। ৩১ এ জুলাই জেলা স্কুলে আর একটি বক্তৃতাও ইংরেজিতে হয়েছিল। তবে সে বিষয়ে বিশেষ কিছু লিপিবদ্ধ নেই।
সম্ভবতঃ এ বারেই আর একটি ছোট হলেও স্মরণীয় ঘটনা অশ্বিনী কুমার দত্তের স্বামীজীর সঙ্গে দেখা করতে আসা। তিনি আসতেই দেখলেন ঘোড়ায় চড়ে এক সন্ন্যাসী ফিরলেন আর এক সাহেব ঘোড়াটিকে যথাস্থানে নিয়ে গেলেন। স্বামীজী (ঘোড়ায় চড়া সন্ন্যাসীও) ততক্ষনে ভেতরে ঢুকেছেন। অশ্বিনী কুমার এক নবীন সাধুকে জিজ্ঞাসা করলেন , ' নরেন দত্ত আছেন ?' তিনি উত্তর দিলেন , ' নরেন দত্ত বলে এখানে কেউ নেই। তিনি অনেক দিন মারা গেছেন। ' অশ্বিনী কুমার অপ্রতিভ এবং ব্যথিত হলেন। কিন্তু ততক্ষনে স্বামীজী ভেতর থেকে এ সব কথা শুনে তাঁকে ভেতরে নিয়ে যেতে বললেন এবং সাদর অভ্যর্থনা করে আগের বার বেশি কথা বলতে পারেন নি বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন। ..... সে কত দিনের কথা ! শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে নরেনের সঙ্গে পরিচয় করতে বলেছিলেন। কিন্তু স্বামীজী অসুস্থ থাকায় বেশি কথা হয় নি। এত কাল পরে স্বামীজীর তাঁকে চিনতে কোন অসুবিধা হয় নি। অশ্বিনী কুমার শিক্ষাব্রতী বলে তাঁকে বলেছিলেন , ' এই তো কাজ। ছাত্রদের বজ্রের মত দৃঢ় চরিত্র গঠন করতে হবে। সমস্ত জাতিকে জাগাতে হবে। সভা-সমিতিতে প্রস্তাব পাশ করে দেশের স্বাধীনতা আসবে না। '
আলমোড়া ত্যাগ করে স্বামীজী উত্তর ভারতের নানা স্থান - কাশ্মীর, পাঞ্জাব , রাজস্থান ইত্যাদি ঘুরে সারা ভারত কে জেগে ওঠার মন্ত্র শোনালেন। পরে কলকাতায় ফিরে স্বাস্থ্যের জন্যে দার্জিলিং গেলেন। ফিরেই কলকাতায় প্লেগ নিবারনের কাজে নেমে পড়লেন। অবস্থার কিছু উন্নতি হলে, ক্যাপ্টেন ও শ্রীমতি সেভিয়র স্বামীজীর পরিকল্পিত হিমালয় অঞ্চলে আশ্রমের জন্যে স্থান সন্ধানসূত্রে আলমোড়ায় থাকতে স্বামীজিকে সেখানে যেতে অনুরোধ করলেন।
ক্ষেত্রীর মহারাজও তখন নৈনিতালে ছিলেন। তিনিও স্বামীজিকে নিমন্ত্রণ করলেন। কাজেই তৃতীয় বারের জন্য স্বামীজী আবার আলমোড়ার দিকে রওনা হলেন ১৮৯৮ সালের মে মাসে। এবার সঙ্গে ছিলেন গুরুভাই স্বামী তুরীয়ানন্দে ও স্বামী নিরঞ্জনানন্দ , স্বীয় শিষ্যদ্বয় স্বামী সদানন্দ ও স্বামী স্বরূপানন্দ এবং শ্রীমতি ওলিবুল, শ্রীমতি মাইকলিওড , ভগিনী নিবেদিতা ও কলকাতাস্থ আমেরিকার কনসাল-জেনারেলের স্ত্রী শ্রীমতি পাইটর্সন। নৈনিতালে স্বামীজীর সঙ্গে মহম্মদ সর্ফরাজ হোসেন নামীয় এক ভদ্রলোকের পরিচয় হয়। তিনি স্বামীজীর আধ্যাত্মিকতা এবং ব্যক্তিত্বে এতেই আকৃষ্ট হন যে তিনি বলেন , ভবিষ্যতে যদি স্বামীজিকে কেউ অবতার বা ভগবানের এক বিশেষ প্রকাশ বলে দাবি করে, তবে প্রথমেই তিনি সেই ব্যক্তি হবেন।
এবারে স্বামীজী আলমোড়ায় সেভিয়ার দম্পতির অতিথি হিসাবে তাঁদের ভাড়া নেওয়া বাড়িতে থাকলেন। সেটিও তখন লালা বদ্রি শা'র বাড়ি ছিল। এর একদিকের বারান্দায় এখনও স্বামীজীর একটি পুরানো ছবি প্রলম্বিত আছে। নিবেদিতা এবং অন্যান্য পাশ্চত্য মহিলারা রইলেন আর একটি বাড়িতে , যেটি 'ওকলে হাউস' নাম পরিচিত। স্বামীজী রোজ খুব সকালে প্রাতভ্রমন সেরে ' ওকলে হাউস' আসতেন এবং প্রাতরাশের সঙ্গে চলতো কয়েক ঘন্টা সকলের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা। অনুরক্ত এবং আগন্তুক ব্যক্তিদের সঙ্গে ক্রমাগত কথা, অসংখ্য চিঠি লেখা এবং কোলাহলের মধ্যে স্বামীজীর দেহ ও মন ক্রমাগতই নির্জন ধ্যানের শান্তি চাইছিল। নিবেদিতার মনেও কিছু দ্বন্দ্ব তাঁকে কাতর করেছিল, এবং স্বামীজীর বিশ্রাম তিনি কামনা করছিলেন।
আলমোড়ার আর একটি বিশেষ ঘটনা এই পরিপ্রেক্ষিতে ঘটে গেল। একদিন সন্ধ্যায় স্বামীজী অপ্রত্যাশিতভাবে 'ওকলে হাউস ' এলেন। নিবেদিতা ও অন্যান্যরা বারান্দায় বসেছিলেন। স্বামীজী নিবেদিতা কে বললেন , 'আজ অমাবস্যা ! মুসলমানরা অমাবস্যা মানে। আমি আবার বনের দিকে যাচ্ছি , যখন ফিরবে শান্তি নিয়ে আসবে। ' বলে নিবেদিতাকে আশীর্বাদ করলেন। নিবেদিতার মনে পড়ল শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন , একদিন এমন হবে যে নরনের স্পর্শে লোকের জ্ঞানোদয় হবে। নিবেদিতার আজ সেই দিন। তিনি সে দিন যথার্থ গুরু পেলেন , যিনি ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যেতে পারেন। গভীর ধ্যানে নিবেদিতা অনাস্বাদিত অনুভূতি লাভ করলেন।
পরের দিন ভোরে স্বামীজী সিয়া দেবী পাহাড়ে (৪৫ কি.মি. ) চলে গেলেন। তিন দিন তিন রাত ধ্যানের পর (২৮ এ মে ) যখন স্বামীজী ফিরলেন তখন 'টমসন হাউসে' র সামনে নিবেদিতা প্রভৃতি সকলেই উপস্থিত ছিলেন। উজ্জ্বল মুখে স্বামীজী বললেন , তিনি এখনও সেই আগের নগ্নপদ সন্ন্যাসী , যে শীত- গ্রীষ্মের দাস নয় , পশ্চিম জগৎ যার কোন ক্ষতিই করতে পারে নি।
এবার আলমোড়া থাকার সময় (প্রায় এক মাস ) শ্রীমতি এনি বসন্তের সঙ্গে স্বামীজীর দুবার সাক্ষাৎ হয়। আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, স্বামীজীর প্রেরণায় মাদ্রাজে যে ইংরেজি পত্রিকা ' প্রবুদ্ধ ভারত ' শুরু হয়ে অল্প দিন পরেই সম্পদকের মৃত্যুতে বন্ধ হয়ে যায়, তা ক্যাপ্টন সেভিয়েরের সোৎসাহে সহযোগিতায় প্রেস খুলে আলমোড়া থেকে প্রকাশিত হতে থাকে , স্বামী স্বরূপানন্দের সম্পাদনায়। সেভিয়র ও স্বামীজী নিজেও ঘুরে যখন আলমোড়ার কাছাকাছি কল্পিত আশ্রমের জায়গা পাওয়া গেল না এবং পরে যখন প্রায় ৯০ কি.মি. দূরে মায়াবতীতে অদ্বৈত আশ্রম স্থাপিত হল তখন ১৯৯৯ সালে 'প্রবুদ্ধ ভারতের ' কার্যালয় সেখানে স্থানান্তরিত হয়।
আগেও যা দেখেছি , স্বামীজী যতবার হিমালয়ের নিভৃত কন্দরে লুকোতে চেয়েছেন , এ তাপদগ্ধ পৃথিবী ততবার তাঁকে কঠোরভাবেই আকর্ষণ করেছে। ৩০ এ মে স্বামীজী সেভিয়রদের সঙ্গে আশ্রমের জায়গার খোঁজে কিছু দূরে গিয়েছিলেন। ৫ ই জুন ফিরে দুঃসংবাদ পেলেন। পাওহারি বাবা গত হয়েছেন। আর তাঁর প্রিয় শ্রুতিলেখক জোসিয়া গুডউইন যাঁর অসাধারন ত্যাগ , নিষ্ঠা ও দীর্ঘ পরিশ্রমের জন্যে আজ আমরা স্বামীজীর অমূল্য বাণী-সংগ্রহ পাচ্ছি , উটকামণ্ডে লোকান্তরিত হয়েছেন। স্বামীজী অনেকক্ষন স্তব্ধ হয়ে থেকে বলেছিলেন , ' আমার সাধারনের কাছে বলার দিন শেষ হয়েছে। তার কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য। কেউ যদি আমার কোন ভাব থেকে কিছু লাভবান হয়ে থাকে , তার জানা উচিত যে, আমার প্রত্যেকটি কথা ধরে রাখার পেছনে গুডওইনের (যাঁকে স্বামীজী 'গুরুদাস ' বলতেন) অক্লান্ত ও নিঃস্বার্থ প্রয়াসই দায়ী। '
এবার স্বামীজী যে সব আলোচনা করেছিলেন তার অনেক কিছুই নিবেদিতা তাঁর 'স্বামীজীর সহিত হিমালয় ' ও 'স্বামীজীকে যেমন দেখিয়াছি ' গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। আধ্যাত্মিক বিষয় ছাড়াও তাঁর আলোচনায় ভারতের জাতীয় চেতনার জাগরণ , সাধারনের সার্বিক উন্নতি ও স্বাধীনতার স্বপ্নও বার বার আসত, যেমন অশ্বিনী কুমারের সঙ্গে আলোচনায় দেখা গেছে।
বিদেশ থেকে স্বামীজী ভারতের ভাবসাগরের ঢেউ এমন উত্তাল করে তুলেছিলেন যে, ইংরেজ সরকারের গোয়েন্দারা তাঁর গতিবিধির উপর নজর রাখতে। ইংলণ্ডে নিবেদিতা একজনকে লিখতে গিয়ে একখানা চিঠিতে লিখেছিলেন, ' পৌরুষ কোন বাধা মানে না। স্বামীজী এসব কথা শুনে হাসেন। সরকার যদি স্বামীজীর বিষয়ে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করতে যায় , তা পাগলামি হবে। কারন সারাদেশ তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ওঠবে। একজন গভীর স্বদেশানুরাগিণী ইংরেজ মহিলা হয়ে আমিতো প্রথম ওঠে দাঁড়াব। '
ভক্তদের নিয়ে স্বামীজী ১১ ই জুন ১৮৯৮ আলমোড়া থেকে কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ক্ষীরভবানী , অমরনাথ প্রভৃতি দর্শন করে আবার ফিরে গেলেন সমতলের সর্বমাবের মাঝে এক অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে। হিমালয়ের আকর্ষণ থেকে আবার ফিরে যেতে হওয়ায় একটা ক্ষোভ হল এবং তা গিয়ে শেষ অবধি পড়ল তাঁর 'গুরুদেব , আচার্য, জীবনের আদর্শ, ইষ্ট, প্রাণের দেবতা ' শ্রীরামকৃষ্ণনের উপর। মা সারদা শুনে বললেন , ' কি করবে বল, বাছা , তোমার টিকি যে তাঁর কাছে বাঁধা। '
স্বামীজীর পরিকল্পিত অদ্বৈত ভাবে সাধনার ক্ষেত্র হিসাবে হিমালয় অঞ্চলে আশ্রম স্থাপন উপযুক্ত জায়গা না পাওয়ায় আলমোড়ার কাছাকাছি সম্ভব হয় নি। কিন্তু ক্যাপ্টন সেভিয়রের আপ্রাণ চেষ্টায় মায়াবতীতে সে আশ্রম গড়ে ওঠেছিল। সেভিয়ার সত্যিই আশ্রমের জন্যে প্রাণ দিয়েছিলেন। তাঁর সেখানেই মৃত্যু হয় এবং অনতিদূরস্থ ছোট পাহাড়ি নদীর ধারে তাঁর শরীরের অগ্নি-সংস্কার হয়।
স্বামীজী দ্বিতীয় বার বিদেশে গিয়েছিলেন। সে আশ্রমে তাঁর যাওয়া হয়নি। আমেরিকা , ইউরোপ ও আফ্রিকা ঘুরে স্বামীজী বোম্বাই -এ নেবেই ক্যাপ্টেন সেভিয়রের খবর নিতে গিয়ে জানলেন , মাত্র ক'দিন আগেই তাঁর দেহান্ত হয়েছে।
স্বামীজী বেলুড়ে ফিরেই মায়াবতীর যাবার উদ্যোগ করলেন। যথেষ্ট আগে মায়াবতীতে সে খবর না দিতে পারায় ভাবলেন , মায়াবতীর কাউকে কাঠগোদামে না পেলে আলমোড়া হয় যাবেন। তাই লালা বদ্রী শা কে তার করলেন। কাঠগোদাম পৌঁছে দেখলেন , স্বামী বিরজানান্দ (কালীকৃষ্ণ ) মায়াবতী থেকে ডান্ডি নিয়ে যাবার জন্যে পাঠিয়েছেন। এদিকে বদ্রী শা লালা গোবিন্দলাল শা কে আলমোড়া নিয়ে যাবার জন্যে পাঠিয়েছেন। এবার স্বামীজীর সঙ্গে স্বামী শিবানন্দ এবং স্বামী সদানন্দ ছিলেন।
কালীকৃষ্ণ ও স্বামী শিবানন্দের পরামর্শে আলমোড়ায় গেলে আটকে পড়তে হবে অথচ মায়াবতী শীঘ্রই যাওয়া প্রয়োজন বলে , আলমোড়া না গিয়ে সোজা পথে তাঁরা মায়াবতী রওনা হলেন (৩০ সে ডিসেম্বর ১৯০০। ) কিন্তু গোবিন্দলাল তাঁদের সঙ্গ ছাড়লেন না।
ফেরার পথে অন্তত যাতে স্বামীজীকে আলমোড়ায় আনা যায় এই ভেবে। অবশ্য তা আর হয়ে ওঠে নি। পথে সকলকেই দ্বিতীয়দিনে খুবই কষ্ট পেতে হয় বৃষ্টি ও তুষার পাটের জন্যে। তবু ১ লা জানুয়ারি ১৯০১ মৌরনালার ডাকবাংলোয় আলমোড়ার আতিথেয়তা গোবিন্দলালের মাধ্যমে স্বামীজী গ্রহণ করেছিলেন।
আলমোড়ার পর্বতশিখরের পশ্চিম প্রান্তে (ব্রাইট এন্ড কর্নার ) পাহাড়ের ঢালে ১৯১৮ সালে স্বামী তুরীয়ানন্দ 'রামকৃষ্ণ কুটীর ' নামে একটি আশ্রম স্থাপন করেন। এখান থেকে সিয়াদেবী পাহাড়টি অপূর্ব দেখায়। সেখানে পুরুষসিংহ স্বামী বিবেকানন্দ দীর্ঘ তপস্যা করেছিলেন। পাহাড়টির চূড়ায় কিছু গাছপালা দীর্ঘকাল এমনভাবে আছে দেখলে মনে হয় যেন একটি সিংহ।
সামনে কোশী নদীটি এঁকে বেঁকে চলে গেছে দীর্ঘপথ। অনতিদূরে কিছু নীচে একটি পুরান বাড়ি আজও দাঁড়িয়ে আছে। লালা বদ্রী শা'দেরই 'চিলকাপেট হাউস। ' স্বামী তুরিয়ানন্দ আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর চলে এসেছিলেন আলমোড়ায় এবং স্বামী শিবানন্দের সঙ্গে এ বাড়িতে থাকতেন ও কঠোর তপস্যায় কালাতিপাত করেছেন। স্বামী বিবেকানন্দের বহু স্মৃতিবিজড়িত আলমোড়ায় আশ্রমটি একটি তীর্থ-কেন্দ্র হয়ে ওঠেছে। সাধু, ভক্ত যাঁরাই এখানে আসেন স্বতঃই তাঁদের মন অন্তর্মুখ হয়ে যায়।
কাছেই রয়েছে 'বিবেকানন্দ গবেষণাগার। ' স্বামীজীর প্রথম শিষ্য স্বামী সদানন্দের শিষ্য- ' বশী সেন' স্বামী বিবেকানন্দের ভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে কৃষি-নির্ভর ভারতের সাধারনের সেবার উদ্দেশ্যে উদ্ভিদ শারীরবৃত্ত ও কৃষি বিষয়ে গবেষণার জন্যে এটি শুরু করে ছিলেন। ভারতবর্ষে এ বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে এটিই ছিল অগ্রণী।
আশ্রম থেকে প্রায় তিন কিলোমিটর দূরে আলমোড়ায় প্রথম বার আসবার সময় পথশ্রমে ও অনাহারে ক্লান্ত হয়ে স্বামীজী যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানে এখন 'স্বামী বিবেকানন্দ স্মৃতি বিশ্রামাগার' তৈরি হয়েছে। ১৯৭১ সালে ৪ ঠা জুলাই এর উদ্বোধন হয়। এতদঞ্চলে স্বামীজীর স্মারক হিসাবে এটি একক। এর পাশ দিয়েই এখন চমৎকার বাস রাস্তা। রৌদ্র বর্ষা তুষারপাতে যাত্রীরা এখানে আশ্রয় পেতে পারে আর স্বামীজীর অনুধ্যানে মগ্ন হতে পারে।
পাশেই সেই প্রস্তরখন্ড আর অনতিদূরে কবরস্থানের পাশে সেই ফকিরের আস্তানাটি দেখা যায়। বিশ্রামাগারের জলের কলটিই এখানে পানীয়ের একমাত্র উৎস। হলটি চারপাশ খোলা। দূরে হিমালয়ের শুভ্র শৃঙ্গরাজি। চারিদিকে পাকা টবে নানা ফুল , চারদিক দিয়ে লতানে ফুলের গাছ উপরে ওঠেছে। আমেরিকান শিল্পী আর্ল ক্রিস্টারের আঁকা স্বামীজীর একটি কল্পনাকৃতি উপর থেকে নেমে আসা জাফরির গায়ে প্রলম্বিত। ঢুকতেই তা ধ্যানসিদ্ধ স্বামীজীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
পশ্চাৎপটে চিত্রিত আছে শিবালয় হিমালয়ের মানস সরোবর আর কৈলাশ। তিন দিকে যাত্রীদের বসার জন্যে গাঁথা বেঞ্চি আছে। থামগুলিতে কাচের নীচে স্বামীজীর দশটি বাণী ইংরেজি , হিন্দি ও উর্দুতে খোদিত আছে। এতে আছে সেবা, কর্ম , ধর্ম , আদর্শ , ঐক্য , বিস্বাস, মুক্তি , চরিত্র , সত্য , আর সর্বকালের সকল মহাপুরুষকে প্রণতি। এ বাণীগুলির প্রথমটি এরূপ : " এই মাতৃভূমির প্রতিই আমার সারাজীবনের আনুগত্য ; এবং আমাকে যদি সহস্রবার জন্মগ্রহণ করিতে হয় , তবে সেই সহস্র জীবনের প্রতি মুহূর্ত আমার স্বদেশবাসীর , হে আমার বন্ধুবর্গ - তোমাদেরই সেবায় ব্যাতিত হইবে !"
[ নবনীদার ইচ্ছানুরূপ ২৪ বর্ষ আগে ৪ মার্চ ১৯৯৬ ত এর প্রথম হিন্দি অনুবাদ কমপ্লিট হচ্ছিলো ]
Covid-19 lock-down : 13 th April 2020
---------------------------------------
আলমোড়ার আকর্ষণ : अल्मोड़ा का आकर्षण : Attractions of Almora :
শ্রী নবনীহরন মুখোপাধ্যায় / श्री नवनीहरन मुखोपाध्याय/ Shri Navniharan Mukhopadhyay/অখিল ভারত বিবেকানন্দ যুব মহামন্ডল/ अखिल भारत विवेकानन्द युवा महामण्डल/ Akhil Bharat Vivekananda Yuva Mahamandal. /
প্রকাশক : प्रकाशक : Publisher:/ শ্রী তনুলাল পাল, সহ-সভাপতি , অখিল ভারত বিবেকানন্দ যুব মাহামণ্ডল, 'ভুবন -ভবন ', পো: বলরাম ধর্মসোপান, খড়দহ , উঃ ২৪ পরগনা , পশ্চিমবঙ্গ ,৭৪৩১২১/ श्री तनुलाल पाल, उपाध्यक्ष, अखिल भारत विवेकानन्द युवा महामण्डल, 'भुवन-भवन', पो: बलराम धर्मसापान, खड़दह, उत्तर- 24 परगना, पश्चिम बंगाल-743121 / Shri Tanulal Pal, Vice-President, Akhil Bharat Vivekananda Yuva Mahamandal, 'Bhuban-Bhavan', Po Balram Dharmasapan, Khardaha, North -24 Parganas , West Bengal-743121
প্রকাশ : পৌষ , ১৪০২, December 1995/ प्रथम प्रकाश : पौष बंगाब्द 1402, दिसम्बर -1995 /
Published- December 1995/ প্রাপ্তিস্থান : उपलब्धता: Provenance/ মহামণ্ডল শহর কার্যালয়, महामण्डल का सिटी ऑफिस, कोलकाता -9, City Office of Mahamandal/শ্রীরামকৃষ্ণ কুটির , আলমোড়া , উত্তর প্রদেশ /श्री रामकृष्ण कुटीर, अल्मोड़ा, उत्तर प्रदेश/ Sri Ramakrishna Cottage, Almora, Uttar Pradesh/ মুদ্রক : मुद्रक: Printer/ The Pelican Press, কম্পিউটার টাইপসেটের ও অফসেট প্রিন্টার , ৮৫, বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিট , কলকাতা/ 85, बिपिन बिहारी गांगुली स्ट्रीट, कोलकाता। 85, Bipin Bihari Ganguly Street, Kolkata.
দিল্লি থেকে আলমোড়া (৩৭৮ কি.মি.) বাসে যাওয়া যায়। সময় লাগে প্রায় ১২ ঘন্টা। সাধারণত লোকে লক্ষ্ণৌ হয়ে যায়। লক্ষ্ণৌ থেকে কাঠগোদাম (৩৮৮ কি.মি. ) রাত ভোর রেল যাত্রা। সকালে কাঠগোদাম থেকে বাস , ট্যাক্সি ইত্যাদিতে আলমোড়া (৮৭ কি.মি. খৈরনা হয়ে ) যেতে লাগে প্রায় ৩ ঘন্টা। সমুদ্রতল থেকে আলমোড়ার উচ্চতা ৪৯৩৮ ফুট।
আলমোড়ার কাছাকাছি কয়েকটি জায়গা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে প্রসিদ্ধ। রানীক্ষেত (৫০ কি.মি.) তুষারাবৃত হিমালয়ের দৃশ্য, মিষ্টি বাতাস আর অপূর্ব আবহাওয়ার জন্যে যাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয়। রানীক্ষেত সমুদ্রতল থেকে ৬০০০ ফুট উচ্চ।
কৌশানির ( ৫৩ কি.মি., সমুদ্রতল থেকে ৫৬৭০ ফুট ) প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনন্য। ১৯২৯ সালে মহাত্মা গান্ধী এখানে এসে কিছুদিন ছিলেন। এখানের পরিবেশে তিনি গীতা -অনাসক্তি -যোগ- ভাষ্য রচনা করেন। তিনি বলেছিলেন , প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এ স্থানের চেয়ে সেরা আর কোন জায়গা আছে কিনা সন্দেহ। এখানের সূর্যোদয় , সূর্যাস্ত দেখার মত। সূর্যোদয় কালে হিমালয়ের তুষারশুভ্র শৃঙ্গগুলি হয়ে ওঠে টকটক লাল, আর সূযাস্তের সময় সোনার রঙ।
একটি অপূর্ব হ্রদকে বেষ্টন করে ছোট পাহাড়ি শহর নৈনিতাল (আলমোড়া থেকে ৬৮ কি.মি. সমুদ্রতল থেকে ৬৮১৪ ফুট ) সকলেরই জানা। হুদের তীরে আর পাহাড়ের উপরের বনরাজির সৌন্দর্য অপূর্ব। হৃদে নৌকাবিহার এখানের এক বিশেষ আকর্ষণ ; যেমন আকাশ পথে তারের দোলায় চূড়ায় উঠে হিমালয় আর হ্রদাদি দর্শন। রাত্রে হরেক ঘরবাড়ি আর রাস্তার আলোর মালা হৃদের লহর কাটা জলে যখন দুলে ওঠে তখন যেন এক ঐন্দ্রজালিক মায়ার সৃষ্টি হয়। এখান থেকে ২৫ কি.মি. -এর মধ্যে মৈনা শৃঙ্গ , ভীমতাল, সাততাল প্রভৃতি দেখতে গিয়ে থাকেন।
আলমোড়া থেকে ১২২ কি.মি. দূরে পিথোরাগড় শহর প্রাচীন মন্দির ইত্যাদির জন্যে প্রসিদ্ধ। কুমায়ুন অঞ্চলের প্রাচীন চাঁদ রাজাদের সময়কার বহু দর্শনীয় স্থানের অবশেষে এখানে রয়েছে। এটি যেন একটি ছোটখাট কাশ্মীর। সমুদ্রতল থেকে এর উচ্চতা ৫৪৪৫ ফুট। পিথোরাগড় থেকে ২০৮ কি.মি. দূরে উত্তর প্রদেশের হিমালয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হিমবাহ মিলাম। শেষের ৫৪ কি.মি. হেঁটে যেতে হয়।
আলমোড়া এককালে নাকি ভগবান বিষ্ণুর আবাসস্থল ছিল। স্কন্দ পুরাণে এমন উল্লেখ আছে। কশায়া পাহাড়ের উপর ৫ কি.মি. লম্বা ঘোড়ার জিনের আকারের সরু লম্বা চূড়ায় শহরটি অবস্থিত। প্রায় ১২ কি.মি. এলাকায় এ শহরের জনবসতি (১৯৮১ -র আদমশুমারি অনুসারে ) ২০, ০০০ এর কিছু বেশি। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৪.৪ থেকে ২৯.৪ সেলসিয়াস কমে বাড়ে। বৃষ্টিপাত নৈনিতাল , শিমলা, মুসৌরি বা দার্জিলিং -এর তুলনায় কম, গড় ৩৭"। বলা যায় নাতিশীতোষ্ণ , নাতি-আদ্র। খুব স্বাস্থ্যকর জায়গা বলে আলমোড়া বহুকাল প্রসিদ্ধ। এখান থেকে উত্তরে নন্দাদেবী , ত্রিশূল প্রভৃতি প্রায় কুড়িটি হিমালয়ের তুষার ঢাকা শৃঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়। ১৫৯২ খিরষ্টাব্দে চাঁদ রাজাদের রাজধানী হিসাবে এ শহরের পত্তন। এখানের দীর্ঘ বাজার এলাকা পুরানো কালের পাহাড় অঞ্চলের বাজার হিসাবে নাম করা।
শহর থেকে ৫ কি.মি. দূরে কালিমঠ। সেখান থেকে সমস্ত শহরটি সুন্দর দেখায়। আর কিছু দূর গেলেই এক পাহাড়ের উপর কাশার দেবীর ও শিবের মন্দির। ৮ কি.মি. দূরে এ অঞ্চলের বিখ্যাত গল্লু দেবতার মন্দির। জায়গাটার নাম চৈতাই। ইনি এক রাজপুত্র ছিলেন। কিন্তু অলৌকিক শক্তির জন্যে দেবতায় রূপান্তরিত হয়েছেন। সকলের সব অভীষ্ট সিদ্ধ করেন। ভক্তরা মন্দিরে ঘন্টা দান করেন। ফলে এত ঘন্টা যে মন্দির ও সমস্ত চওরের ঘন্টা গুনে শেষ করা শক্ত।
৩৪ কি.মি. দূরে জগেশ্বর শিবের মন্দির অপূর্ব পরিবেশে বিশাল দেওদার বন আর জটাগঙ্গা নদীর তীরে। এখানে আর এক শিব আছেন। তাঁর নাম মহামৃত্যুঞ্জয়। তাঁকে বলে বুড়ো শিব , আর জগেশ্বর হলেন বালক শিব। তবে স্থানীয় লোক বলে ইনি দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম।
উত্তর-পূর্বে প্রায় ৮০ কি.মি. বাসে কাপকোট গিয়ে ৫৮ কি.মি. হাঁটা পথে পিন্ডারী হিমবাহ। এই হিমবাহেই এ অঞ্চলে সবচেয়ে সহজে যাওয়া যায়।
শহরের ৩ কি.মি. দূরে এক হরিণক্ষেত্র আছে। ৩০ কি.মি. দূরে বিন্সারের অরণ্য সৌন্দর্যে সকলেরই মনোহরণ করে।
প্রকৃতি ও পর্বতপ্রিয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বার দুই (১৯০৩, ১৯৩১) আলমোড়ায় এসে থেকেছেন এবং তাঁর 'শিশু', 'ছড়ার ছবি ', 'সেঁজুতি '-র অনেকগুলি নিয়ে চল্লিশটির বেশি কবিতা আলমোড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশে বসে লেখা।
স্বাস্থ্যের আকর্ষণ ছাড়া আলমোড়া কর্ণপ্রয়াগ , রুদ্রপ্রয়াগ , কেদারনাথ , বদ্রীনাথ , গঙ্গোত্রী , যমুনোত্রী , কৈলাশ প্রভৃতি তীর্থে যাবার অন্যতম পথও। শ্রীরামকৃষ্ণের সন্তানদের মধ্যে স্বামী অখণ্ডানন্দ (গঙ্গাধর ) হিমালয় অঞ্চলে ও তিব্বতে অনেক ঘুরেছিলেন। এঁদের মধ্যে তিনিই আলমোড়া প্রথম যান। শ্রীরামকৃষ্ণের দেহান্তের পর নরেন্দ্রাদি (বিবেকানন্দ প্রমুখ ত্যাগী যুবকগণ) বরাহনগর মঠে থাকছিলেন। কিন্তু ত্যাগ ও তপস্যার (সেবার) প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাঁদের ছিটকে বার করে নিয়ে গেসল ভারতের নানা ক্ষেত্রে।
বিবেকানন্দ কয়েকবার এখান ওখান ঘুরে এসে হিমালয়ে এক সাধনার নির্জন স্থান খোঁজ করার উদ্দেশ্যে অখণ্ডানন্দকে সঙ্গী করে কাঠগোদাম হাজির হলেন। একশ বছের আগে বাস বা রাস্তা কিছুই ছিল না। দন্ড-কমণ্ডলু আর ভিক্ষান্ন সম্বল করে বিবেকানন্দ ও খণ্ডানন্দ পাহাড়ি পথে হেঁটে নৈনিতাল পৌঁছলেন।
কদিন পর আবার চলা শুরু হল আলমোড়া পথে। বিবেকানন্দ মাঝে মাঝে নির্দিষ্ট পথ ছেড়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলতে লাগলেন। তৃতীয় দিনে উভয়ে রাত কাটাবার জন্যে একটি মনোরম স্থান দেখতে পেলেন। পথের পাশে দিয়ে বয়ে গেছে কোশি (কৌশিকী) নদী। অসংখ্য ছোট-বড় নুড়ি আর পাথরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী পায়ে হেঁটে পেরিয়ে যাওয়া যায়। অপর দিক থেকে সরোতা নদী এসে পড়েছে কোশির বুকে। মাঝের ত্রিকোণাকৃতি ভূখণ্ড ক্রমশ উঁচু হয়ে গেছে। তার উপর একটি প্রকান্ড পিপুল গাছ। স্বামীজী বললেন , 'কি চমৎকার ধ্যানের জায়গা !' কোশিতে স্নান করে পেরিয়ে বসলেন সেই গাছের নীচে তৎক্ষণাৎ শরীর নিস্পন্দ হয়ে গেল গভীর ধ্যানে। বহুক্ষণ পর ধ্যান ভাঙলে অখন্ডানন্দকে (গঙ্গাধর ) বললেন , " আজ আমার এক গভীর জিজ্ঞাসার সমাধান হয়ে গেল। প্রথমে শব্দব্রহ্ম ছিল। অনুবিশ্ব আর বৃহৎ -বিশ্ব একই পরিকল্পনানুসারে সৃষ্ট। জীবাত্মা যেমন জীবদেহে , বিশ্বাত্মাও তেমন প্রকৃতিতে অবস্থিত। বাক আর অর্থের মতই এরা অচ্ছেদ্য। ব্রহ্মের এই দুই রূপ সনাতন। কাজেই আমরা যে জগৎ দেখি তা শাশ্বত নিরাকার ও শাশ্বত সাকারের সম্মিলন। "
এ জায়গাটার নাম কাঁকড়িঘাট , আলমোড়া থেকে ২৩ কি.মি. দূরে। শেষে যখন তাঁরা আলমোড়ার কাছাকাছি (৩ কি.মি.) পৌছেছেন তখন স্বামীজী পথশ্রমে ও প্রচণ্ড ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর। পা ফোস্কায় ভরে গেছে। প্রায় অজ্ঞান হয় স্বামীজী তখন একখণ্ড পাথরের উপর শুয়ে পড়লেন। অখণ্ডানন্দ দিশেহারা হয়ে কিছু খাবার আর জলের খোঁজ করতে ব্যস্ত হলেন। অনতিদূরেই এক কবরস্থানের পাশে এক কুটরীর কাছে এক মুসলমান ফকিরকে দেখতে পেয়ে তাঁর কাছে গেলেন। ফকিরের একটি শশা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ফকির নিজেই শশাটি নিয়ে ছুটে এলেন। কিন্তু বললেন , তিনি মুসলমান। স্বামীজী ক্ষীণকন্ঠে বললেন , ' তাতে কি ? আমরা সবাই কি ভাই নেই ? ' শশাটি খেয়ে স্বামীজীর প্রাণরক্ষা হল। ..... স্বামীজী আমেরিকা থেকে ফিরে দ্বিতীয়বার যখন আলমোড়া যান, আর তাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়, তখন সভাস্থলে ভিড়ের মধ্যে সেই ফকিরটিকে দেখে স্বামীজী ঠিক চিনতে পারেন এবং সভাস্থলে তাঁকে এনে তাঁর দ্বারা তাঁর জীবনরক্ষার কাহিনী কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সকলকে শোনান।
স্বামীজী প্রথম বার যখন আলমোড়া গিয়ে পৌঁছলেন সেটা ছিল ১৮৯০ সালের আগষ্ট মাসের শেষ বা সেপ্টেম্বরের প্রথম। শহরে পৌঁছেই স্বামী সারদানন্দ ও কৃপানন্দের (বৈকুন্ঠ নাথ সান্যাল ) সঙ্গে স্বামীজী ও অখণ্ডানন্দের দেখা হল। তাঁরা স্বামীজীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আলমোড়ায় অপেক্ষা করছিলেন। সকলেই শহরের এক অতি সজ্জন ব্যক্তি , ধনী হলেও ধনলাভের কালিমা যাঁকে স্পর্শ করেনি --লালা বদ্রি শা'র বাড়িতে উঠলেন।
১৮৮৯ সালে যখন স্বামীজী আলমোড়া যাবার কথা ভাবছিলেন , তখন বদ্রীনাথ থেকে অখণ্ডানন্দ বদ্রি শা'কে স্বামীজীর পরিচয় দিয়ে তাঁর আলমোড়ায় যাবার ইচ্ছার কথা জানান। স্বামী বিবেকানন্দের পরিচয় দিতে গিয়ে অখণ্ডানন্দ সে চিঠিতে লিখেছিলেন যে , বিবেকানন্দ শুধু উচ্চ শিক্ষিত নন , ঈশ্বরের জন্যে যথার্থই সর্বস্ব ত্যাগ করে তিনি কঠোর সন্ন্যাস-জীবন যাপন করেন এবং তিনি 'পরমহংস ' পর্যায়ের এক উচ্চকোটি সন্ন্যাসী।
শ্রী রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে থাকা কালেই বিবেকানন্দ (নরেন্দ্র ) সমাধি আস্বাদ করেছিলেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যাতে তিনি সেই ব্রহ্মাস্বাদেই ডুবে থাকতে পারেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ চেয়েছিলেন নরেন লোককল্যানের জন্যে উচ্চ ভূমিতেই না থেকে মানুষের মাঝে নেমে আসুক। যেন অলৌকিক ভাবেই তা ঘটেছিল আর সে বিষয়ে স্বামীজীর আলমোড়ায় অবস্থান স্মরণীয় হয় থাকবে।
লালা বদ্রীর শা'র আতিথেয়তায় কোন ত্রূটি ছিল না। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের মন ছটপট করছিল অন্য কিছুর জন্যে, নির্জনতার জন্যে , গভীরতর আধ্যাত্মিক উপলব্ধির জন্যে। তিনি একাকী বেরিয়ে পড়লেন। ......কাশার দেবী পাহাড়ের এক গুহায় চলল নিরবচ্ছিন্ন দিনরাত্রি কঠোর তপস্যা। একান্ত নির্জনতায় , নৈঃশব্দে ধীরে ধীরে তাঁর মুখমন্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠলো এক দিব্য আলোকে , চূড়ান্ত সত্যের প্রভায়। যেন বুঝলেন শ্রীরামকৃষ্ণের 'জ্ঞানের পরে বিজ্ঞান ' কথার অর্থ। শুধু ব্রহ্মজ্ঞানে ডুবে থাকা নয়। ....' তিনিই সব হয়েছেন'--- জেনে সর্বজীবের কল্যাণই শেষ কথা। নরেনের বিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের ইচ্ছা-বীজ অঙ্কুরিত হল বিবেকানন্দের অপরোক্ষ অনুভূতির প্রত্যয়ে।
আলমোড়ায় ফিরেই খেলেন সেই জগতের এক ধাক্কা। ভগিনীর উদ্বন্ধনে জীবনান্তের সকরুণ সংবাদ। চার সন্ন্যাসী মিলেরওনা হলেন বদ্রীনাথের পথে । কিন্তু প্রায় দু'শ কিলোমিটার হাঁটার পর একের পর একজন অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলেন। অগত্যা কিছু নেমে সাধু-সন্তদের প্রিয় হৃষিকেশে পৌঁছলেন , যেখানে 'হর হর' রবে হিমালয়ের উপর থেকে বয়ে গঙ্গা ভারতের সমতলে উপনীত হচ্ছে। কিছুদিন পর মীরাট থেকে আবার নিঃসঙ্গ একাকী পরিব্রাজক ভারত -পথিক , সে ভারতকে চিনতে যার সেবার জন্যেই তাঁর জন্মগ্রহণ। কত অঘটন ঘটে গেল ! নীলাম্বুরাশি পেরিয়ে আমেরিকার আকাশে ক্যালঝ্ঞ্ঝার মাঝে বজ্রের মত ফেটে পড়লেন। হেয় ম্লানমুখী ভারত আবার জগতের সামনে আপন প্রভায় সমুজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
বিশ্ববন্দিত বিবেকানন্দ ১৮৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতে ফিরলেন। সিংহল থেকে শুরু হল দেশজুড়ে অগণিত দেশবাসীর অকুন্ঠ অভিনন্দন আর প্রত্যুত্তরে ' ভারতে বিবেকানন্দ ' বিধৃত স্বামীজীর অনবদ্য বক্ত্রতামালায় ক্লিষ্ট খিন্ন নিদ্রিত ভারতবাসীর জন্যে হৃদয় ঢালা ভালবাসা দিয়ে ভরা অনন্য জাগানিয়া গান ! ক'বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যে দার্জিলিং -এ কিছুদিন কাটিয়ে পূর্ন স্বাস্থ্যোদ্ধার মানসে আবার আলমোড়া যেতে চাইলেন। ....ইতোমধ্যে কলকাতায় ১ লা মে ১৮৯৭ রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা হল। ৬ ই মে আলমোড়ার দিকে পা বাড়ালেন। আসল উদ্দেশ্য কিন্তু হিমালয় অঞ্চলে একটি আশ্রম স্থাপন ,' যেখানে কাজই প্রাধান্য পাবে না, প্রাধান্য পাবে শান্ত সমাহিত ভাব আর ধ্যানের গভীরতা। '
এবারে সবকিছুই অন্য রকম। স্বামীজীর বাণীর শ্রুতিলেখক গুডউইন এবং অন্যরা এসেছেন কাঠগোদামে আলমোড়া থেকে। স্বামীজী ঘোড়ার পিঠে পাহাড় চড়বেন, সঙ্গে থাকবেন গুডউইন। আলমোড়ার কাছাকাছি রাস্তায় বহু লোক অপেক্ষা করছিল। স্বামীজিকে একটি সুসজ্জিত ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে শোভাযাত্রা করে নিয়ে যেতে লাগল বাকী পথ। পথের পাশের বাড়ী থেকে গৃহবধূরা মাঙ্গলিক পুষ্পাক্ষত বৃষ্টি করতে লাগলেন। লালা বদ্রি শা'র বাড়ীর সামনে প্রকাণ্ড সামিয়ানা টাঙান হয়েছে। প্রায় তিন হাজার লোক সেখানে সমবেত। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দুধারের বাড়ীর আলোক-সজ্জায় চারদিক আলোকিত।
অভ্যর্থনা সমিতির পক্ষ থেকে পণ্ডিত জ্বালাদত্ত জোশি হিন্দিতে একটি সংক্ষিপ্ত অভিনন্দন পাঠ করলেন। তাতে তাঁর পাশ্চাত্ত্যে আধ্যাত্মিক বিজয়ের উল্লেখ করে বলা হল, 'আপনি কৃতার্থ , আপনার পরম শ্রদ্ধেয় গুরুদেব গৌরবান্বিত , আর ভারতভূমি ধন্য।' স্বামীজীর হিমালয়ে আশ্রমপ্রতিষ্ঠার ইচ্ছায় কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ' শঙ্করাচার্যও হিমালয়ে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আপনার কল্পিত আশ্রম কুমায়ুনীদের অশেষ কল্যাণ করবে। ' এর পর লালা বদ্রি শাহ খুলঘরিয়ার পক্ষ থেকে একটি ইংরেজি ভাষণ পাঠ করেন পণ্ডিত হরিরাম পাণ্ডে। অপর এক পণ্ডিত সংস্কৃতে একটি অভিনন্দন পাঠ করেন। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে দিন স্বামী বিবেকানন্দ ইংরেজিতে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণে অভিনন্দনের উত্তর দেন। তিনি বলেন , ' এই সেই পবিত্র ভূমি , সেখানে ভারতের প্রত্যেক যথার্থ সত্যপিপাসু ব্যক্তি জীবন-সন্ধ্যায় আসিয়া শেষ অধ্যায় সমাপ্ত করিতে অভিলাষী হয়। এই পবিত্রভূমির গিরিশখরে , গভীর গহবরে, দ্রুতগামিনী স্রোতস্বতীসমূহের তীব্র সেই অপূর্ব তত্ত্বগুলির কণামাত্র বৈদেশিকগনের নিকট হইতেও গভীর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়াছে এবং যেগুলিকে যোগ্যতম বিচারকগণ অতুলনীয় বলিয়া নিজেদের মত প্রকাশ করিয়াছেন। আমার প্রাণের বাসনা এই পর্বতরাজের ক্রোড়ে আমার শেষ দিনগুলি কাটাইবে। ' তিনি আরও বলেন , ' ভবিষ্যতে পৃথিবীর সর্বস্থানে হইতে বীরহৃদয় ব্যাক্তিগন এই শৈলরাজের দিকে আকৃষ্ট হইবেন - যখন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিরোধ ও মতপার্থক্য লোকের স্মৃতিপথ হইতে অন্তর্হিত হইবে , যখন তোমার ধর্মে ও আমার ধর্মে যে বিবাদ তাহা একেবারে অন্তর্হিত হইবে।'
এবারে তিনি আলমোড়ায় প্রায় তিন মাস কাটান। তার মধ্যে অবশ্য শরীর ভাল বোধ না হওয়ায় দুবারে প্রায় একমাস ৩২ কি.মি. দূরে দেউলধরে লালা বদ্রি শা'র এক বাগানবাড়িতে থেকে আসেন। সেখানে ফল দুষ খেয়ে আর প্রচুর ঘোড়ায় চড়ে তাঁর শরীর বেশ লাগতে লাগলো।
এসময় স্বামীজীর বেশ ক'জন গুরুভাই এবং অনুরক্তরা আলমোড়ায় এসেছিলেন। স্বামী শিবানন্দ (মহাপুরুষ মহারাজ) সাড়ে তিন কি.মি. দূরে পাতাল দেবীতে ধ্যান করে কাটাতেন। মাঝে মাঝে স্বামীজীর সঙ্গে দেখা হোত, স্বামীজী ওখান থেকেই তাঁকে সিংহল পাঠিয়ে দিলেন। সিংহলে রামকৃষ্ণ মিশনের কেন্দ্র স্থাপন করে কিছু দিন থেকে তিনি মঠ ফেরেন। ইতোমধ্যে আলমবাজার থেকে বেলুড়ে নীলাম্বর মুখুজ্জের বাড়িতে মঠ স্থানান্তরিত হয়েছে। মিশন স্থাপনের ক'দিনের মধ্যেই স্বামীজী কলকাতা থেকে চলে এসেছিলেন। কিছু ত্রাণের কাজও শুরু করে এসেছিলেন। কাজেই আলমোড়া থেকেই তাঁকে এ সব বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দিতে হচ্ছিল।
তা ছাড়া বহু জিজ্ঞাসু নানা প্রশ্ন নিয়ে হাজির হোত। দীর্ঘ আলোচনা চলতো। বিদেশী ভক্তরাও যতটা পারা যায় তাঁর সঙ্গ করতে চাইতেন। সব চিঠিতে নানা প্রশ্ন বা নির্দেশ প্রার্থনা থাকত। প্রচুর দীর্ঘ চিঠিও ক্রমাগত লিখতে হোত। শিষ্য শরৎ চক্রবর্তীকে লিখছেন , 'আমাদের দয়া নয় , প্রেম। সকলের মধ্যে আত্মদর্শন। ' স্বামী ব্রহ্মানন্দ (রাখাল ) -কে লিখছেন , ' আমাদের সঙ্ঘের উদ্দেশ্যের যে ছাপা বয়ান পাঠিয়েছিলে , তা সংশোধন করে পাঠালাম। ' এও চলছে আলমোড়া থেকে। আবার লিখছেন , 'প্রভুর পুজোর খরচ মাসে এক টাকায় চালাও। প্রভুর সন্তানেরা অনাহারে মরছে। ' 'কলকাতার সভার উদবৃত্ত দুর্ভিক্ষ -ত্রানে পাঠাও বা বস্তিবাসীদের সেবায় লাগাও। স্মৃতি- মন্দির বা ও সব এখন চুলোয় যাক। ' কাউকে লিখছেন , ' যারা নিঃসন্তান তাদের অনেকে যেমন বেরাল পোষে, আমার যেন সেই অবস্থা। আমার যেন পুরুষের চেয়ে নারীর ভাব বেশি। অন্যের যত দুঃখকষ্ট নিজের বুকে টেনে আনি। '
ইংরেজি ও বাংলা ছাড়া এর মধ্যে আবার কিছু চিঠি সংস্কৃতে লিখতেন। একটিতে লিখছেন , 'অহমধুনা আলমোড়া নগরস্যা কিঞ্চিৎ উত্তর কশ্চিদ বণিজ উপবনোপদেশে নিবসামি। ' এ চিঠিতে কিন্তু একটি মূল্যবান বস্তু ছিল। স্বামী শ্রদ্ধানন্দের প্রশ্নের উত্তরে স্বামীজী গীতার একটি শ্লোকের (২ য় অধ্যায় সংখ্যযোগের ৪৬ ) এক অপূর্ব ভাষ্য লেখেন।
আলমোড়া থেকেই স্বামী অখণ্ডানন্দের সেবার কাজে উৎসাহ দিয়ে লিখছেন , 'কার নাম -কিসের নাম ? কে নাম চায় ? দূর কর নাম। ক্ষুধিতের পেটে অন্ন পৌঁছাতে যদি নাম ধাম সব রসাতল যায় আহভাগ্যম মহাভাগ্যম। ' সারগাছিতে সেই কাজের সূত্রপাত। এদিকে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ (শশী মহারাজ ) কে মাদ্রাজে পাঠিয়েছেন এবং নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
আলমোড়া থেকে স্বামীজী চলে যাবেন জানতে পেরে স্থানীয় লোকেরা স্বামীজীর কিছু ভাষণ শোনবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠলো। স্থানীয় ইংরেজ বাসিন্দারা পাশ্চাত্যে স্বামীজীর বাগ্মিতার কথা শুনেছিলেন। তাঁরাও ইংলিশ ক্লাবে (বর্তমান অফিসার্স মেস ) একটি বক্ততার আয়োজন করলেন। ২৭ জুলাই স্বামীজী জেলা স্কুলে (বর্তমান রাজকীয় ইন্টার কলেজ) হিন্দিতে ভাষণ দিলেন। পূর্বে কখন হিন্দিতে বললেও একটি কঠিন বিষয়ের উপর আরগর্ভ ভাষণ স্বামীজীর এই আলমোড়াতেই প্রথম। স্বামীজী একখানি চিঠিতে নিজে তা উল্লেখ করেছিলেন। স্বামীজীর বক্ত্রিতা হিন্দি ভাষাকে নতুন মর্যাদা দিয়েছিল এবং শ্রোতাদের মধ্যে হিন্দিভাষী পণ্ডিতরা মন্তব্য করেছিলেন , এ ভাষণ শুনে তাঁদের মনে হয়েছে যে , হিন্দিতেও বাগ্মি তা সম্ভব।
সে সভায় বিষয় ছিল ' তত্বে ও প্রয়োগে বেদের শিক্ষা। ' প্রায় ৪০০ লোক মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল যখন স্বামীজী কঠিন বিষয়টি প্রকাশের প্রয়াসে হিন্দিতে স্বতঃ নতুন নতুন শব্দ সৃষ্টি করে বলে যাচ্ছিলেন। হিন্দিভাষীদের মধ্যে পণ্ডিতরা হিন্দিকে তেমন সুনজরে দেখতেন না। বাঙালি পণ্ডিত মধুসূদন সরস্বতী তুলসীদাসের 'রামচরিতমানসে'র প্রতি শ্রদ্ধা জাগান। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে বিগত শতাব্দীতে প্রথম হিন্দি গদ্য রচনা ও পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা হয়। এই পশ্চাদ পটে স্বামীজীর এ হিন্দি ভাষণের মূল্য আনেক।
২৮ এ জুলাই ইংলিশ ক্লাবের বক্তৃতা সম্বন্ধে শ্রীমতি হেনরিয়েটা মুলর লিখেছিলেন , ' সময় সময় মনে হচ্ছিল 'আমি' নেই , 'তুমি' নেই , 'এ ' নেই , 'ও ' নেই , বক্তা , তাঁর বাণী আর শ্রোতা সব সেই আত্মবস্তুতে লীন হয়ে গেছে। ৩১ এ জুলাই জেলা স্কুলে আর একটি বক্তৃতাও ইংরেজিতে হয়েছিল। তবে সে বিষয়ে বিশেষ কিছু লিপিবদ্ধ নেই।
সম্ভবতঃ এ বারেই আর একটি ছোট হলেও স্মরণীয় ঘটনা অশ্বিনী কুমার দত্তের স্বামীজীর সঙ্গে দেখা করতে আসা। তিনি আসতেই দেখলেন ঘোড়ায় চড়ে এক সন্ন্যাসী ফিরলেন আর এক সাহেব ঘোড়াটিকে যথাস্থানে নিয়ে গেলেন। স্বামীজী (ঘোড়ায় চড়া সন্ন্যাসীও) ততক্ষনে ভেতরে ঢুকেছেন। অশ্বিনী কুমার এক নবীন সাধুকে জিজ্ঞাসা করলেন , ' নরেন দত্ত আছেন ?' তিনি উত্তর দিলেন , ' নরেন দত্ত বলে এখানে কেউ নেই। তিনি অনেক দিন মারা গেছেন। ' অশ্বিনী কুমার অপ্রতিভ এবং ব্যথিত হলেন। কিন্তু ততক্ষনে স্বামীজী ভেতর থেকে এ সব কথা শুনে তাঁকে ভেতরে নিয়ে যেতে বললেন এবং সাদর অভ্যর্থনা করে আগের বার বেশি কথা বলতে পারেন নি বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন। ..... সে কত দিনের কথা ! শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে নরেনের সঙ্গে পরিচয় করতে বলেছিলেন। কিন্তু স্বামীজী অসুস্থ থাকায় বেশি কথা হয় নি। এত কাল পরে স্বামীজীর তাঁকে চিনতে কোন অসুবিধা হয় নি। অশ্বিনী কুমার শিক্ষাব্রতী বলে তাঁকে বলেছিলেন , ' এই তো কাজ। ছাত্রদের বজ্রের মত দৃঢ় চরিত্র গঠন করতে হবে। সমস্ত জাতিকে জাগাতে হবে। সভা-সমিতিতে প্রস্তাব পাশ করে দেশের স্বাধীনতা আসবে না। '
আলমোড়া ত্যাগ করে স্বামীজী উত্তর ভারতের নানা স্থান - কাশ্মীর, পাঞ্জাব , রাজস্থান ইত্যাদি ঘুরে সারা ভারত কে জেগে ওঠার মন্ত্র শোনালেন। পরে কলকাতায় ফিরে স্বাস্থ্যের জন্যে দার্জিলিং গেলেন। ফিরেই কলকাতায় প্লেগ নিবারনের কাজে নেমে পড়লেন। অবস্থার কিছু উন্নতি হলে, ক্যাপ্টেন ও শ্রীমতি সেভিয়র স্বামীজীর পরিকল্পিত হিমালয় অঞ্চলে আশ্রমের জন্যে স্থান সন্ধানসূত্রে আলমোড়ায় থাকতে স্বামীজিকে সেখানে যেতে অনুরোধ করলেন।
ক্ষেত্রীর মহারাজও তখন নৈনিতালে ছিলেন। তিনিও স্বামীজিকে নিমন্ত্রণ করলেন। কাজেই তৃতীয় বারের জন্য স্বামীজী আবার আলমোড়ার দিকে রওনা হলেন ১৮৯৮ সালের মে মাসে। এবার সঙ্গে ছিলেন গুরুভাই স্বামী তুরীয়ানন্দে ও স্বামী নিরঞ্জনানন্দ , স্বীয় শিষ্যদ্বয় স্বামী সদানন্দ ও স্বামী স্বরূপানন্দ এবং শ্রীমতি ওলিবুল, শ্রীমতি মাইকলিওড , ভগিনী নিবেদিতা ও কলকাতাস্থ আমেরিকার কনসাল-জেনারেলের স্ত্রী শ্রীমতি পাইটর্সন। নৈনিতালে স্বামীজীর সঙ্গে মহম্মদ সর্ফরাজ হোসেন নামীয় এক ভদ্রলোকের পরিচয় হয়। তিনি স্বামীজীর আধ্যাত্মিকতা এবং ব্যক্তিত্বে এতেই আকৃষ্ট হন যে তিনি বলেন , ভবিষ্যতে যদি স্বামীজিকে কেউ অবতার বা ভগবানের এক বিশেষ প্রকাশ বলে দাবি করে, তবে প্রথমেই তিনি সেই ব্যক্তি হবেন।
এবারে স্বামীজী আলমোড়ায় সেভিয়ার দম্পতির অতিথি হিসাবে তাঁদের ভাড়া নেওয়া বাড়িতে থাকলেন। সেটিও তখন লালা বদ্রি শা'র বাড়ি ছিল। এর একদিকের বারান্দায় এখনও স্বামীজীর একটি পুরানো ছবি প্রলম্বিত আছে। নিবেদিতা এবং অন্যান্য পাশ্চত্য মহিলারা রইলেন আর একটি বাড়িতে , যেটি 'ওকলে হাউস' নাম পরিচিত। স্বামীজী রোজ খুব সকালে প্রাতভ্রমন সেরে ' ওকলে হাউস' আসতেন এবং প্রাতরাশের সঙ্গে চলতো কয়েক ঘন্টা সকলের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা। অনুরক্ত এবং আগন্তুক ব্যক্তিদের সঙ্গে ক্রমাগত কথা, অসংখ্য চিঠি লেখা এবং কোলাহলের মধ্যে স্বামীজীর দেহ ও মন ক্রমাগতই নির্জন ধ্যানের শান্তি চাইছিল। নিবেদিতার মনেও কিছু দ্বন্দ্ব তাঁকে কাতর করেছিল, এবং স্বামীজীর বিশ্রাম তিনি কামনা করছিলেন।
আলমোড়ার আর একটি বিশেষ ঘটনা এই পরিপ্রেক্ষিতে ঘটে গেল। একদিন সন্ধ্যায় স্বামীজী অপ্রত্যাশিতভাবে 'ওকলে হাউস ' এলেন। নিবেদিতা ও অন্যান্যরা বারান্দায় বসেছিলেন। স্বামীজী নিবেদিতা কে বললেন , 'আজ অমাবস্যা ! মুসলমানরা অমাবস্যা মানে। আমি আবার বনের দিকে যাচ্ছি , যখন ফিরবে শান্তি নিয়ে আসবে। ' বলে নিবেদিতাকে আশীর্বাদ করলেন। নিবেদিতার মনে পড়ল শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন , একদিন এমন হবে যে নরনের স্পর্শে লোকের জ্ঞানোদয় হবে। নিবেদিতার আজ সেই দিন। তিনি সে দিন যথার্থ গুরু পেলেন , যিনি ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যেতে পারেন। গভীর ধ্যানে নিবেদিতা অনাস্বাদিত অনুভূতি লাভ করলেন।
পরের দিন ভোরে স্বামীজী সিয়া দেবী পাহাড়ে (৪৫ কি.মি. ) চলে গেলেন। তিন দিন তিন রাত ধ্যানের পর (২৮ এ মে ) যখন স্বামীজী ফিরলেন তখন 'টমসন হাউসে' র সামনে নিবেদিতা প্রভৃতি সকলেই উপস্থিত ছিলেন। উজ্জ্বল মুখে স্বামীজী বললেন , তিনি এখনও সেই আগের নগ্নপদ সন্ন্যাসী , যে শীত- গ্রীষ্মের দাস নয় , পশ্চিম জগৎ যার কোন ক্ষতিই করতে পারে নি।
এবার আলমোড়া থাকার সময় (প্রায় এক মাস ) শ্রীমতি এনি বসন্তের সঙ্গে স্বামীজীর দুবার সাক্ষাৎ হয়। আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, স্বামীজীর প্রেরণায় মাদ্রাজে যে ইংরেজি পত্রিকা ' প্রবুদ্ধ ভারত ' শুরু হয়ে অল্প দিন পরেই সম্পদকের মৃত্যুতে বন্ধ হয়ে যায়, তা ক্যাপ্টন সেভিয়েরের সোৎসাহে সহযোগিতায় প্রেস খুলে আলমোড়া থেকে প্রকাশিত হতে থাকে , স্বামী স্বরূপানন্দের সম্পাদনায়। সেভিয়র ও স্বামীজী নিজেও ঘুরে যখন আলমোড়ার কাছাকাছি কল্পিত আশ্রমের জায়গা পাওয়া গেল না এবং পরে যখন প্রায় ৯০ কি.মি. দূরে মায়াবতীতে অদ্বৈত আশ্রম স্থাপিত হল তখন ১৯৯৯ সালে 'প্রবুদ্ধ ভারতের ' কার্যালয় সেখানে স্থানান্তরিত হয়।
আগেও যা দেখেছি , স্বামীজী যতবার হিমালয়ের নিভৃত কন্দরে লুকোতে চেয়েছেন , এ তাপদগ্ধ পৃথিবী ততবার তাঁকে কঠোরভাবেই আকর্ষণ করেছে। ৩০ এ মে স্বামীজী সেভিয়রদের সঙ্গে আশ্রমের জায়গার খোঁজে কিছু দূরে গিয়েছিলেন। ৫ ই জুন ফিরে দুঃসংবাদ পেলেন। পাওহারি বাবা গত হয়েছেন। আর তাঁর প্রিয় শ্রুতিলেখক জোসিয়া গুডউইন যাঁর অসাধারন ত্যাগ , নিষ্ঠা ও দীর্ঘ পরিশ্রমের জন্যে আজ আমরা স্বামীজীর অমূল্য বাণী-সংগ্রহ পাচ্ছি , উটকামণ্ডে লোকান্তরিত হয়েছেন। স্বামীজী অনেকক্ষন স্তব্ধ হয়ে থেকে বলেছিলেন , ' আমার সাধারনের কাছে বলার দিন শেষ হয়েছে। তার কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য। কেউ যদি আমার কোন ভাব থেকে কিছু লাভবান হয়ে থাকে , তার জানা উচিত যে, আমার প্রত্যেকটি কথা ধরে রাখার পেছনে গুডওইনের (যাঁকে স্বামীজী 'গুরুদাস ' বলতেন) অক্লান্ত ও নিঃস্বার্থ প্রয়াসই দায়ী। '
এবার স্বামীজী যে সব আলোচনা করেছিলেন তার অনেক কিছুই নিবেদিতা তাঁর 'স্বামীজীর সহিত হিমালয় ' ও 'স্বামীজীকে যেমন দেখিয়াছি ' গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। আধ্যাত্মিক বিষয় ছাড়াও তাঁর আলোচনায় ভারতের জাতীয় চেতনার জাগরণ , সাধারনের সার্বিক উন্নতি ও স্বাধীনতার স্বপ্নও বার বার আসত, যেমন অশ্বিনী কুমারের সঙ্গে আলোচনায় দেখা গেছে।
বিদেশ থেকে স্বামীজী ভারতের ভাবসাগরের ঢেউ এমন উত্তাল করে তুলেছিলেন যে, ইংরেজ সরকারের গোয়েন্দারা তাঁর গতিবিধির উপর নজর রাখতে। ইংলণ্ডে নিবেদিতা একজনকে লিখতে গিয়ে একখানা চিঠিতে লিখেছিলেন, ' পৌরুষ কোন বাধা মানে না। স্বামীজী এসব কথা শুনে হাসেন। সরকার যদি স্বামীজীর বিষয়ে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করতে যায় , তা পাগলামি হবে। কারন সারাদেশ তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ওঠবে। একজন গভীর স্বদেশানুরাগিণী ইংরেজ মহিলা হয়ে আমিতো প্রথম ওঠে দাঁড়াব। '
ভক্তদের নিয়ে স্বামীজী ১১ ই জুন ১৮৯৮ আলমোড়া থেকে কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ক্ষীরভবানী , অমরনাথ প্রভৃতি দর্শন করে আবার ফিরে গেলেন সমতলের সর্বমাবের মাঝে এক অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে। হিমালয়ের আকর্ষণ থেকে আবার ফিরে যেতে হওয়ায় একটা ক্ষোভ হল এবং তা গিয়ে শেষ অবধি পড়ল তাঁর 'গুরুদেব , আচার্য, জীবনের আদর্শ, ইষ্ট, প্রাণের দেবতা ' শ্রীরামকৃষ্ণনের উপর। মা সারদা শুনে বললেন , ' কি করবে বল, বাছা , তোমার টিকি যে তাঁর কাছে বাঁধা। '
স্বামীজীর পরিকল্পিত অদ্বৈত ভাবে সাধনার ক্ষেত্র হিসাবে হিমালয় অঞ্চলে আশ্রম স্থাপন উপযুক্ত জায়গা না পাওয়ায় আলমোড়ার কাছাকাছি সম্ভব হয় নি। কিন্তু ক্যাপ্টন সেভিয়রের আপ্রাণ চেষ্টায় মায়াবতীতে সে আশ্রম গড়ে ওঠেছিল। সেভিয়ার সত্যিই আশ্রমের জন্যে প্রাণ দিয়েছিলেন। তাঁর সেখানেই মৃত্যু হয় এবং অনতিদূরস্থ ছোট পাহাড়ি নদীর ধারে তাঁর শরীরের অগ্নি-সংস্কার হয়।
স্বামীজী দ্বিতীয় বার বিদেশে গিয়েছিলেন। সে আশ্রমে তাঁর যাওয়া হয়নি। আমেরিকা , ইউরোপ ও আফ্রিকা ঘুরে স্বামীজী বোম্বাই -এ নেবেই ক্যাপ্টেন সেভিয়রের খবর নিতে গিয়ে জানলেন , মাত্র ক'দিন আগেই তাঁর দেহান্ত হয়েছে।
স্বামীজী বেলুড়ে ফিরেই মায়াবতীর যাবার উদ্যোগ করলেন। যথেষ্ট আগে মায়াবতীতে সে খবর না দিতে পারায় ভাবলেন , মায়াবতীর কাউকে কাঠগোদামে না পেলে আলমোড়া হয় যাবেন। তাই লালা বদ্রী শা কে তার করলেন। কাঠগোদাম পৌঁছে দেখলেন , স্বামী বিরজানান্দ (কালীকৃষ্ণ ) মায়াবতী থেকে ডান্ডি নিয়ে যাবার জন্যে পাঠিয়েছেন। এদিকে বদ্রী শা লালা গোবিন্দলাল শা কে আলমোড়া নিয়ে যাবার জন্যে পাঠিয়েছেন। এবার স্বামীজীর সঙ্গে স্বামী শিবানন্দ এবং স্বামী সদানন্দ ছিলেন।
কালীকৃষ্ণ ও স্বামী শিবানন্দের পরামর্শে আলমোড়ায় গেলে আটকে পড়তে হবে অথচ মায়াবতী শীঘ্রই যাওয়া প্রয়োজন বলে , আলমোড়া না গিয়ে সোজা পথে তাঁরা মায়াবতী রওনা হলেন (৩০ সে ডিসেম্বর ১৯০০। ) কিন্তু গোবিন্দলাল তাঁদের সঙ্গ ছাড়লেন না।
ফেরার পথে অন্তত যাতে স্বামীজীকে আলমোড়ায় আনা যায় এই ভেবে। অবশ্য তা আর হয়ে ওঠে নি। পথে সকলকেই দ্বিতীয়দিনে খুবই কষ্ট পেতে হয় বৃষ্টি ও তুষার পাটের জন্যে। তবু ১ লা জানুয়ারি ১৯০১ মৌরনালার ডাকবাংলোয় আলমোড়ার আতিথেয়তা গোবিন্দলালের মাধ্যমে স্বামীজী গ্রহণ করেছিলেন।
আলমোড়ার পর্বতশিখরের পশ্চিম প্রান্তে (ব্রাইট এন্ড কর্নার ) পাহাড়ের ঢালে ১৯১৮ সালে স্বামী তুরীয়ানন্দ 'রামকৃষ্ণ কুটীর ' নামে একটি আশ্রম স্থাপন করেন। এখান থেকে সিয়াদেবী পাহাড়টি অপূর্ব দেখায়। সেখানে পুরুষসিংহ স্বামী বিবেকানন্দ দীর্ঘ তপস্যা করেছিলেন। পাহাড়টির চূড়ায় কিছু গাছপালা দীর্ঘকাল এমনভাবে আছে দেখলে মনে হয় যেন একটি সিংহ।
সামনে কোশী নদীটি এঁকে বেঁকে চলে গেছে দীর্ঘপথ। অনতিদূরে কিছু নীচে একটি পুরান বাড়ি আজও দাঁড়িয়ে আছে। লালা বদ্রী শা'দেরই 'চিলকাপেট হাউস। ' স্বামী তুরিয়ানন্দ আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর চলে এসেছিলেন আলমোড়ায় এবং স্বামী শিবানন্দের সঙ্গে এ বাড়িতে থাকতেন ও কঠোর তপস্যায় কালাতিপাত করেছেন। স্বামী বিবেকানন্দের বহু স্মৃতিবিজড়িত আলমোড়ায় আশ্রমটি একটি তীর্থ-কেন্দ্র হয়ে ওঠেছে। সাধু, ভক্ত যাঁরাই এখানে আসেন স্বতঃই তাঁদের মন অন্তর্মুখ হয়ে যায়।
কাছেই রয়েছে 'বিবেকানন্দ গবেষণাগার। ' স্বামীজীর প্রথম শিষ্য স্বামী সদানন্দের শিষ্য- ' বশী সেন' স্বামী বিবেকানন্দের ভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে কৃষি-নির্ভর ভারতের সাধারনের সেবার উদ্দেশ্যে উদ্ভিদ শারীরবৃত্ত ও কৃষি বিষয়ে গবেষণার জন্যে এটি শুরু করে ছিলেন। ভারতবর্ষে এ বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে এটিই ছিল অগ্রণী।
আশ্রম থেকে প্রায় তিন কিলোমিটর দূরে আলমোড়ায় প্রথম বার আসবার সময় পথশ্রমে ও অনাহারে ক্লান্ত হয়ে স্বামীজী যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানে এখন 'স্বামী বিবেকানন্দ স্মৃতি বিশ্রামাগার' তৈরি হয়েছে। ১৯৭১ সালে ৪ ঠা জুলাই এর উদ্বোধন হয়। এতদঞ্চলে স্বামীজীর স্মারক হিসাবে এটি একক। এর পাশ দিয়েই এখন চমৎকার বাস রাস্তা। রৌদ্র বর্ষা তুষারপাতে যাত্রীরা এখানে আশ্রয় পেতে পারে আর স্বামীজীর অনুধ্যানে মগ্ন হতে পারে।
পাশেই সেই প্রস্তরখন্ড আর অনতিদূরে কবরস্থানের পাশে সেই ফকিরের আস্তানাটি দেখা যায়। বিশ্রামাগারের জলের কলটিই এখানে পানীয়ের একমাত্র উৎস। হলটি চারপাশ খোলা। দূরে হিমালয়ের শুভ্র শৃঙ্গরাজি। চারিদিকে পাকা টবে নানা ফুল , চারদিক দিয়ে লতানে ফুলের গাছ উপরে ওঠেছে। আমেরিকান শিল্পী আর্ল ক্রিস্টারের আঁকা স্বামীজীর একটি কল্পনাকৃতি উপর থেকে নেমে আসা জাফরির গায়ে প্রলম্বিত। ঢুকতেই তা ধ্যানসিদ্ধ স্বামীজীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
পশ্চাৎপটে চিত্রিত আছে শিবালয় হিমালয়ের মানস সরোবর আর কৈলাশ। তিন দিকে যাত্রীদের বসার জন্যে গাঁথা বেঞ্চি আছে। থামগুলিতে কাচের নীচে স্বামীজীর দশটি বাণী ইংরেজি , হিন্দি ও উর্দুতে খোদিত আছে। এতে আছে সেবা, কর্ম , ধর্ম , আদর্শ , ঐক্য , বিস্বাস, মুক্তি , চরিত্র , সত্য , আর সর্বকালের সকল মহাপুরুষকে প্রণতি। এ বাণীগুলির প্রথমটি এরূপ : " এই মাতৃভূমির প্রতিই আমার সারাজীবনের আনুগত্য ; এবং আমাকে যদি সহস্রবার জন্মগ্রহণ করিতে হয় , তবে সেই সহস্র জীবনের প্রতি মুহূর্ত আমার স্বদেশবাসীর , হে আমার বন্ধুবর্গ - তোমাদেরই সেবায় ব্যাতিত হইবে !"
[ নবনীদার ইচ্ছানুরূপ ২৪ বর্ষ আগে ৪ মার্চ ১৯৯৬ ত এর প্রথম হিন্দি অনুবাদ কমপ্লিট হচ্ছিলো ]
" Almorar Akarshan "
Covid-19 lock-down : 13 th April 2020
---------------------------------------
আলমোড়ার আকর্ষণ : अल्मोड़ा का आकर्षण : Attractions of Almora :
শ্রী নবনীহরন মুখোপাধ্যায় / श्री नवनीहरन मुखोपाध्याय/ Shri Navniharan Mukhopadhyay/অখিল ভারত বিবেকানন্দ যুব মহামন্ডল/ अखिल भारत विवेकानन्द युवा महामण्डल/ Akhil Bharat Vivekananda Yuva Mahamandal. /
প্রকাশক : प्रकाशक : Publisher:/ শ্রী তনুলাল পাল, সহ-সভাপতি , অখিল ভারত বিবেকানন্দ যুব মাহামণ্ডল, 'ভুবন -ভবন ', পো: বলরাম ধর্মসোপান, খড়দহ , উঃ ২৪ পরগনা , পশ্চিমবঙ্গ ,৭৪৩১২১/ श्री तनुलाल पाल, उपाध्यक्ष, अखिल भारत विवेकानन्द युवा महामण्डल, 'भुवन-भवन', पो: बलराम धर्मसापान, खड़दह, उत्तर- 24 परगना, पश्चिम बंगाल-743121 / Shri Tanulal Pal, Vice-President, Akhil Bharat Vivekananda Yuva Mahamandal, 'Bhuban-Bhavan', Po Balram Dharmasapan, Khardaha, North -24 Parganas , West Bengal-743121
প্রকাশ : পৌষ , ১৪০২, December 1995/ प्रथम प्रकाश : पौष बंगाब्द 1402, दिसम्बर -1995 /
Published- December 1995/ প্রাপ্তিস্থান : उपलब्धता: Provenance/ মহামণ্ডল শহর কার্যালয়, महामण्डल का सिटी ऑफिस, कोलकाता -9, City Office of Mahamandal/শ্রীরামকৃষ্ণ কুটির , আলমোড়া , উত্তর প্রদেশ /श्री रामकृष्ण कुटीर, अल्मोड़ा, उत्तर प्रदेश/ Sri Ramakrishna Cottage, Almora, Uttar Pradesh/ মুদ্রক : मुद्रक: Printer/ The Pelican Press, কম্পিউটার টাইপসেটের ও অফসেট প্রিন্টার , ৮৫, বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিট , কলকাতা/ 85, बिपिन बिहारी गांगुली स्ट्रीट, कोलकाता। 85, Bipin Bihari Ganguly Street, Kolkata.